'খুন' হওয়া ব্যক্তি ৯ বছর পর বাড়িতে

নয় বছর আগে এলাকা থেকে উধাউ হয়ে গিয়েছিলেন জালাল উদ্দিন (৪০)। তাঁকে অপহরণের পর খুন ও লাশ গুম করা হয়েছে বলে প্রচার করেন স্ত্রী ললিতা বেগম। এই অভিযোগে ললিতা স্থানীয় পাঁচ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে মামলাও করেন। এতে কারাভোগসহ নিঃস্ব হওয়ার দশা ওই পাঁচজনের।

এই যখন অবস্থা তখন আবার উদয় হয়েছেন জালাল উদ্দিন। নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন তিনি। এতে এলাকায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। তাঁকে দেখার জন্য ভিড় করছে মানুষ। এ ঘটনা কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলার লাকুহাটি গ্রামের।

জালাল উদ্দিন (৪০) নামের ওই ব্যক্তিকে অপহরণ ও খুনের অভিযোগে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর থানায় পাঁচজনকে আসামি করে তাঁর স্ত্রী একটি মামলা করেছিলেন। ওই মামলায় নয় বছর ধরে পলাতক আছেন দুজন। বাকি আসামিরা দীর্ঘদিন কেউ আদালতে আত্মসমর্পণ করে আবার কেউ গ্রেপ্তার হয়ে কারাভোগ করেছেন। যাঁর জন্য এত কিছু এখন সেই জালাল উদ্দিন বাড়ি ফিরে আসায় মামলাটি পুনঃ তদন্ত করে বিচার দাবি করেছেন ভুক্তভোগী আসামিরা।

জালাল উদ্দিন গত সোমবার দুপুরে কিশোরগঞ্জের দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হন। এ সময় তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে বিচারকের বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন। সেখানে বলেন, তিনি স্ত্রীর দায়ের করা মামলার আসামিদের হাতে আটক ছিলেন। ওই সময় নিয়মিত নেশাযুক্ত ইনজেকশন দেওয়া হতো তাঁকে। এতে তিনি মানসিক ভারসাম্য ও স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘদিন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় ঘুরে বেড়ানোর পর সম্প্রতি কিছুটা স্মৃতিশক্তি ফিরে পেয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।

আইনজীবী এ কে এম আমিনুল হক বলেন, ভুক্তভোগী জালাল উদ্দিন আসামিদের অত্যাচারে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি এখনো পুরোপুরি সুস্থ নন এবং বর্তমানে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন।

অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটনের জন্য জালাল উদ্দিনকে আদালতের হেফাজতে নিয়ে জবানবন্দি নেওয়ার আবেদন জানালেও বিচারক তা আমলে নেননি।

এ ব্যাপারে মিজানুর রহমান বলেন, এটা মিথ্যা ও সাজানো মামলা। শুধু আসামিদের হয়রানি করতেই মামলাটি করা হয়েছে।

আদালত ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা যায়, হোসেনপুর উপজেলার গোবিন্দপুর ইউনিয়নের লাকুহাটি গ্রামের জালাল উদ্দিনকে অপহরণ ও হত্যার পর লাশ গুমের অভিযোগে তাঁর স্ত্রী ললিতা বেগম ২০১০ সালের ৩১ মার্চ হোসেনপুর থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার আসামিরা হচ্ছেন একই এলাকার শংকর বাবু, আসাদ মল্লিক, রুহুল আমিন, হিরা মিয়া ও আজহারুল ইসলাম। এর মধে৵ রুহুল আমিন সম্পর্কে হিরা মিয়ার ভাতিজা ও আজহারুল ইসলাম ভাগনে।

মামলায় ললিতা বেগম আসামি শংকর বাবু ও আসাদ মল্লিককে আদম ব্যাপারী এবং বাকি তিনজনকে সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, চাকরিসহ সৌদি আরব পাঠানোর কথা বলে আসামিরা তাঁর স্বামীর কাছ থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু পরে জালাল উদ্দিনকে আর বিদেশে না পাঠিয়ে বিভিন্ন টালবাহানায় ঘোরাতে থাকেন। একপর্যায়ে আসামিরা বিদেশ যাওয়ার কথা বলে তাঁর স্বামীকে ঢাকায় নেন। এরপর ললিতা বেগম আর স্বামীর কোনো খোঁজ পাননি বলে মামলায় উল্লেখ করেন।

এদিকে মামলা দায়েরের পর থেকে শংকর বাবু ও আসাদ মল্লিক পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া রুহুল আমিন ও হিরা মিয়া তিন বছর পলাতক থাকার পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে তিন মাস কারাভোগ করেন। এর মধ্যে হিরা মিয়াকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। অপর আসামি আজহারুল আড়াই বছর পলাতক থাকার পর আগাম জামিন নিয়ে বাড়িতে ফেরার পর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। আজহারুল চার মাস কারাভোগ করেন। মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা শাখার এসআই মুর্শেদ জামান পাঁচজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এরপর তিন আসামি আরও এক মাস করে কারাভোগ করেন।

সোমবার আদালতে উপস্থিত হয়ে হিরা মিয়া, রুহুল আমিন ও আজহারুল ইসলাম বলেন, তাঁরা নির্দোষ এবং বাদীর সঙ্গেও তাঁদের কোনো বিরোধ নেই। তাঁরা প্রত্যেকে কৃষিকাজসহ ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাঁদের হয়রানি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা এবং মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে তাঁরা সর্বস্বান্ত হওয়াসহ সামাজিকভাবে হেয় ও অপমানিত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। এই তিন আসামিই এত দিন পর জালাল উদ্দিনের ফিরে আসার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন ও তাঁদের হয়রানির বিচার দাবি করেন।