বিস্ময় জাগানো দিনলিপির মেয়েটি

গতকাল আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অস্থায়ী গ্যালারিতে অ্যান ফ্রাঙ্ককে নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো l প্রথম আলো
গতকাল আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অস্থায়ী গ্যালারিতে অ্যান ফ্রাঙ্ককে নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো l প্রথম আলো

‘প্রথমে আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া সাংবাদিক হব, তারপর আমি বিখ্যাত লেখক হতে চাই। যা-ই ঘটুক, যুদ্ধের পরে আমি দ্য সিক্রেট অ্যানেক্স নামের বই প্রকাশ করতে চাই।’ ১৩ বছর বয়সী ইহুদি পরিবারের সন্তান অ্যান ফ্রাঙ্ক তার ডায়েরিতে লিখেছিল এ কথা। তার লেখায় ছিল উদ্দীপনা, কৌতূহল, চাঞ্চল্য। কিন্তু ১৫ বছর বয়সেই তার ডায়েরি লেখায় ইতি টানতে হয়।

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ইহুদিদের ওপর অত্যাচার শুরু হলো। পাঠানো হলো বন্দিশিবিরে। তখন অটো ফ্রাঙ্ক নিজের পরিবারের সঙ্গে বাড়ির পেছনে গোপন আস্তানায় আশ্রয় নেন। মেয়ে অ্যানের বয়স তখন ১৩ বছর ২ মাস। চোখে তার রঙিন স্বপ্ন। কিন্তু ঘরে অবরুদ্ধ হয়ে রইল ছোট্ট এক কুঠুরিতে। একের পর এক কাছের মানুষকে হারাতে হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত কিশোরী অ্যানও রক্ষা পেল না। মৃত্যুপুরী থেকে ফিরতে পেরেছিলেন একমাত্র বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। তিনিই অ্যানের স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি নামে। ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন প্রকাশিত হয় অ্যানের ডায়েরির প্রথম সংস্করণ। বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয় ১৩ বছর বয়সী এই মেয়েটির বিস্ময়কর পরিণত ভাবনা।

বিশ্বরাজনীতি এবং সাহিত্যের ইতিহাসে আলোচিত চরিত্র অ্যান ফ্রাঙ্ককে কেন্দ্র করে প্রদর্শনী ‘অ্যান ফ্রাঙ্ক—এ হিস্টরি ফর টুডে’। এ বিশেষ প্রদর্শনী দিয়ে গতকাল আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অস্থায়ী গ্যালারি উদ্বোধন করা হলো। অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি ও তার পারিবারিক ছবির অ্যালবামকে উপজীব্য করে এই প্রদর্শনীটি পৃথিবীর ৮০টি দেশে নিয়মিত প্রদর্শিত হয়েছে বলে জানালেন আয়োজকেরা
শনিবার সকালে প্রদর্শনীটি যৌথভাবে উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি কুলেনারা। উদ্বোধনী পর্বে বক্তব্য দেন নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শেখ মুহাম্মদ বেলাল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, সারওয়ার আলী, ভারতের শিল্পসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান সিগাল ফাউন্ডেশনের মিনা মালহোত্রা, অ্যান ফ্রাঙ্ক হাউস প্রতিনিধি প্রিয়া মাচারো ও লুস সিংগেলস, প্রদর্শনীর অন্যতম আয়োজক কাউন্টার ফটোর চেয়ারম্যান খন্দকার বজলুল হক, অধ্যক্ষ খন্দকার সাইফুল হক এবং কাউন্টার ফটোর গ্লোবাল কো-অর্ডিনেটর সোহান রাহাত।

মৃত্যুর পর যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে অ্যান এবং অ্যানের সেই ডায়েরি। প্রাসঙ্গিক হয়েছিল বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যায়, প্রাসঙ্গিক হয়েছে ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যায়। এখন দুনিয়াজুড়ে ডায়েরি আর অ্যান ফ্রাঙ্ক যেন সমার্থক। অ্যানের স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। কিন্তু ১৫ বছর বয়সেই স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গে জীবনেরও ইতি টানতে হয় তাকে। কিন্তু অ্যান তার মতো কিশোরীদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়ে গেছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নানাজনের বক্তৃতায় এ কথাগুলোই ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়।

অনুষ্ঠানে অ্যান ফ্রাঙ্কের ডায়েরি থেকে ইংরেজি এবং বাংলায় কিছু অংশ পাঠ করেন মাশকুরুর রহমান ও সীমা আক্তার। যুগে যুগে গণহত্যায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে মঞ্চে প্রদীপ জ্বালান বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। অ্যান ফ্রাঙ্ক হাউস আয়োজিত এ প্রদর্শনী ও কর্মশালার আয়োজনে সার্বিক সহযোগিতা করেছে কাউন্টার ফটো ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। প্রদর্শনীটি ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রদর্শনীর অংশ হিসেবে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাছাইকৃত ২০ জন শিক্ষার্থী ও ২০ জন শিক্ষককে নিয়ে অ্যান ফ্রাঙ্কের জীবন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, গণহত্যা সম্পর্কে একটি শিক্ষামূলক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে।

সুপরিসর গ্যালারিতে ঢুকতেই চোখে পড়ে অ্যান ফ্রাঙ্কের মুখচ্ছবি। সাদাকালোতে বালিকাসুলভ মিষ্টি হাসি। ছবিটা এমন একসময়ে তোলা, যখন অ্যানের জীবনে বিভীষিকা নেমে আসেনি। প্রদর্শনীজুড়ে আছে অ্যান ফ্রাঙ্কের পুরো জীবন। লেখায়, ছবিতে। ১৯২৯ সালের ১২ জুন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে জন্ম, নেদারল্যান্ডসে পালিয়ে আসা, গোপন কুঠুরির জীবন, লেখক হওয়ার বাসনা—সবকিছু নানাভাবে উঠে এসেছে প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীতে একই সমান্তরালে স্থান পেয়েছে হিটলার ও তাঁর নাৎসি দলের উত্থান, সামরিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন স্থিরচিত্র।

প্রদর্শনীর বিভিন্ন ছবি এবং লেখার তথ্য বলছে, নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টার্ডাম শহরের কেন্দ্রে প্রিনসেনগ্রাখট এলাকার ২৬৩ নম্বর ভবনটি ছিল অ্যানের বাবা অটো ফ্রাঙ্কের ব্যবসাকেন্দ্র। ভবনের পেছন দিকে দোতলা ও তিনতলাজুড়ে ছোট একটা অ্যানেক্স ভবন ছিল, যা সামনে থেকে মোটেও দেখা বা বোঝা যেত না। ফ্রাঙ্ক পরিবার এখানেই লুকিয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। ফ্রাঙ্ক পরিবারের সদস্য ছিল চারজন—অটো ফ্রাঙ্ক, তাঁর স্ত্রী এডিথ, দুই মেয়ে মারগট ও অ্যান।

১৯৪৪ সালের ৪ আগস্টে জার্মানদের কাছে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ৭৬১ দিন এই অ্যানেক্স ভবনে কাটিয়ে দেয় তারা। এখানেই অ্যান তার ১৩তম জন্মদিনে উপহার পাওয়া লাল-সাদা চেক মলাটের ডায়েরিতে দিনলিপি লিখতে শুরু করে।

জন্মদিনে পাওয়া ডায়েরিতে ১২২টি পৃষ্ঠা ছিল। অ্যান ১৯৪২ সালের ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে এটিতে দিনলিপি লিখে শেষ করে ফেলে। এরপর নতুন নতুন নোটবই এবং ৩২৪টি আলগা কাগজে অ্যান তার দিনলিপি লিখে রাখে।

১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট গোপন ঘরের সবাই ধরা পড়ে যান। অটো ফ্রাঙ্ক ছাড়া সবাই বন্দিশিবিরগুলোয় মৃত্যুবরণ করেন। অ্যান ফ্রাঙ্ক জার্মানির হ্যানোভার শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বার্জেন-বেলসন বন্দিশিবিরে ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে চলে যায় জীবনের ওপারে।