৩৫ পরিবারের হাতে বিপন্ন

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনের ভেতরে গাছ সাবাড় করে মাটি কেটে জমি দখলে নিচ্ছে দখলদারেরা। ছবি: প্রথম আলো
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনের ভেতরে গাছ সাবাড় করে মাটি কেটে জমি দখলে নিচ্ছে দখলদারেরা। ছবি: প্রথম আলো

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি দখলকারী ৩৫টি পরিবার আবারও বনের গাছ কেটে তাদের জমির আয়তন বাড়াচ্ছে। এ কাজে বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা ও প্রহরীদের সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সপ্তাহে সোমবার থেকে বনের জমি দখলকারীরা গাছ সাবাড় করে মাটি কেটে তাদের জমি দখল শুরু করে। এতে বন ও এর জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে।

এর আগে ২০১৩ সালে বনের ওই অংশের গাছ কেটে ৩৫টি পরিবার বনের অন্তত ৮ একর জমি দখলে নিয়ে সেখানে ঘরবাড়ি তোলে এবং পুকুর খনন করে সেখানে বসবাস শুরু করে। ওই সময় বন বিভাগের পক্ষ থেকে দখলদারদের বিরুদ্ধে ১২টি মামলা করা হয়। এসব মামলা বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান আছে। পরিবারগুলো এখন তাদের জমির আয়তন বাড়াতে বনের গাছ কেটে পুনরায় দখলপ্রক্রিয়া শুরু করেছে।

পাথরঘাটা উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর—এ তিন নদ-নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত হরিণঘাটার সৃজিত বনাঞ্চলে হরিণ, বানর, শূকর, কাঠবিড়ালি, মেছো বাঘ, ডোরা বাঘ, শজারু, উদ, শৃগালসহ অসংখ্য বুনো প্রাণীর বিচরণ। হরেক প্রজাতির পাখির কলরবে সারাক্ষণ মুখর থাকে হরিণঘাটা। মূলত সুন্দরবনের চেয়ে আকৃতিতে বড় প্রজাতির মায়াবি চিত্রল হরিণের বিচরণস্থল হওয়ায় এই বনের নামকরণ হয় হরিণঘাটা।

বন বিভাগ জানায়, ১৯৬৭ সাল থেকে বন বিভাগ হরিণঘাটা বনটিকে সরকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। কেওড়া, সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, ছৈলা, কাঁকড়া, আমুর, বাইন, করমজা, খলিসাসহ নানা প্রজাতির বৃক্ষশোভিত সৃজিত এই বনের আয়তন কাগজে–কলমে প্রায় ৬ হাজার একর। সংরক্ষিত এ বনকে পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিলের অর্থায়নে ২০১৫ সালে বন বিভাগ বনের ভেতরে পর্যটকদের প্রবেশের জন্য ফুট ট্রেইল (পায়ে চলা পথ), ওয়াচ টাওয়ার, বিশ্রামাগার, গোলঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে।

পাথরঘাটা উপজেলা রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে ১৬ জানুয়ারি যোগদান করেছেন সাইদুর রহমান আকন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে বনের জমি কাউকে দখলে নিতে দেওয়া হবে না।

হরিণঘাটা এলাকার কয়েক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, বনের জমি দখলের কাজে বন বিভাগের চরলাঠিমারা বিট কর্মকর্তা মো. বদিউজ্জামানসহ অপর দুই বন প্রহরী সহায়তা করছেন।

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করে চরলাঠিমারা বিট কর্মকর্তা মো. বদিউজ্জামান বলেন, জনবলের অভাবে সব সময় খোঁজখবর রাখা যায় না। দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাঁরা বনকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করে মিথ্যা মামলা দেন।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বাঁধ ধরে সংরক্ষিত বনের দিকে হাঁটতেই একটি বড় পুকুর দেখা গেল। পুকুরের পাড় ধরে এগোতেই চোখে পড়ে, দুই কিশোর বনের মাটি কাটছে। কাছে গিয়ে তাদের পরিচয় জানতে চাইলে দৌড়ে তারা পালিয়ে যায়। এ সময় পাশে থাকা ফোরকান নামের এক ব্যক্তি বলেন, কয়েক দিন ধরে বনের মধ্যে মাটি কেটে চৌহদ্দি দিয়ে আয়তন বাড়াচ্ছে দখলদারেরা। ওই চৌহদ্দির পেছনে বিস্তৃত বন।

একটু এগোতেই বনের জমিতে বেশ কয়েকটি ঘর দেখা গেল। মানসুরা বেগম, ইলিয়াছ খান, কবির সরদার ও বাদল হাওলাদার ঘরগুলোর মালিক। এগুলোর পেছনে গিয়ে দেখা গেল, মানসুরা বেগম তাঁর পুরোনো দখল করা জমির পাশ ধরে নতুন করে আবারও মাটি কেটে বনের জমি দখলে নিয়েছেন। বনের গাছের ডালপালা কেটে নতুন করে দখলে নেওয়া জমিতে বেড়া দিচ্ছেন। একইভাবে ইলিয়াছ খান, কবির সরদার, বাদল হাওলাদারসহ অন্য দখলদারেরাও বনের গাছ সাফ করে মাটি কেটে জমির আয়তন বাড়াচ্ছেন। তাঁরা বনের মধ্যে প্রথমে মাটি ফেলে, পরে গাছের ডালপালা ও জাল দিয়ে শক্ত বেড়া দেন।

বাড়িগুলো থেকে আরেকটু এগোতেই বনের করুণ দশা চোখে পড়ল। আশপাশে তেমন কোনো গাছ নেই, কিছু দূরে বড় বড় কয়েকটি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের কাণ্ড ও ডালপালা নেই। দেখে বোঝা যায়, এসব গাছ মেরে ফেলার জন্য এই কৌশল নিয়েছে দখলদারেরা।

দখলদারদের মধ্যে আকলিমা বেগম দাবি করেন, ১৯৮৯-৯০ সালে এরশাদ সরকার ভূমিহীন হিসেবে তাঁদের ৩৮টি পরিবারকে ৩৮ একর এবং মসজিদের জন্য দুই একর জমি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেন। কিন্তু জমি বুঝিয়ে না দেওয়ায় তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলা এখনো চলছে। এই অবস্থায় তাঁরা বনের মধ্যে জমি দখল নেন।

জানতে চাইলে বরগুনা-পটুয়াখালী অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার বলেন, বিষয়টি তিনি জানেন না। খোঁজ নিয়ে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।