আজ উনসত্তরের উনপঞ্চাশ

শহীদ আসাদুজ্জামান আসাদ
শহীদ আসাদুজ্জামান আসাদ

মৃতের জানাজা মোরা কিছুতেই করিব না পাঠ/ কবরেরও ঘুম ভাঙে/ জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ নিহত হন। পরদিনের দৈনিক আজাদ-এ নিহত আসাদের ছবির নিচে পরিচিতি হিসেবে ওপরের দুটি পঙ্‌ক্তি ছাপা হয়েছিল। লিখেছিলেন সাংবাদিক সন্তোষগুপ্ত।

কোনো কোনো কবিতা সময়কে ধারণ করে। আর কোনো কোনো সময় কবিকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় অবিস্মরণীয় পঙ্‌ক্তি। উনসত্তর ছিল সে রকমই এক উত্তাল সময়। সেই আন্দোলনের মুহূর্তে রোমান্টিক কবি হিসেবেই বেশি খ্যাত শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’ এর চার দিন পর ২৪ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র মতিউর। আর মতিউরকে নিয়ে আল মাহমুদ লিখেছিলেন, ‘ট্রাক ট্রাক ট্রাক/ শুয়োরমুখো ট্রাক/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিউরকে ডাক।’

সেদিন আসাদ, মতিউরসহ আরও অনেক তরুণ রাজপথে খুন ঝরিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। আজ সেই ২৪ জানুয়ারি, গণ-অভ্যুত্থান দিবসের উনপঞ্চাশতম বার্ষিকী। আর এক বছর পরই অর্ধশতক পূরণ হবে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের কী অঙ্গীকার ছিল? আমরা কতটা তার পূরণ করেছি, কতটা পূরণ করতে পারিনি, সেই চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানো জরুরি। অতীতের স্মৃতিচারণা নয়, সামনে এগোনোর পথ সন্ধানের জন্য।

উনসত্তরের অভ্যুত্থানের সূচনা ঘটে ১৯৬৮ সালের ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। পাকিস্তান সরকার ‘পাকিস্তান: দেশ ও কৃষ্টি’ নামে বাঙালি চেতনাবিরোধী একটি বই পাঠ্য হিসেবে চাপিয়ে দিতে চাইলে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ জানায়। তখন চলছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারকাজ। প্রতিদিনের আদালতের সওয়াল-জবাব পত্রিকায় ছাপা হতে থাকলে গণমানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একপর্যায়ে ছাত্রজনতা রাজপথে নেমে আসে। তারা স্লোগান তোলে, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’

এরপর মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দীর্ঘদিনের নীরবতা ভেঙে আন্দোলনের ডাক দিলে জনবিক্ষোভের মাত্রা বেড়ে যায়।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল কার্যত একাত্তরেরই প্রস্তুতিপর্ব। আর এই গণ-আন্দোলনে ছাত্র-তরুণ-সংস্কৃতিসেবী ও পেশাজীবীরা নিয়েছিলেন অগ্রণী ভূমিকা। বিশেষ করে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপ ও এনএসএফ থেকে বেরিয়ে আসা একটি অংশের সমন্বয়ে ৪ জানুয়ারি ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ হলে আন্দোলন গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ঘোষিত ১১ দফা হয়ে ওঠে গণমানুষের কর্মসূচিতে। শিক্ষাঙ্গন ছাড়িয়ে সরকারি অফিস, শহরের বস্তি ও শ্রমিকের কারখানা পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনের ঢেউ।

ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ছয় দফা কর্মসূচির সম্পূরক হিসেবে ১১ দফা ঘোষণা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে এর অনেকগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে, আবার অনেকগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। কিন্তু উনসত্তরের উনপঞ্চাশে এসেও ১১ দফার যেসব দাবি ও কর্মসূচি আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে, সেগুলোর পুনরুল্লেখ করা জরুরি মনে করি।

১১ দফায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছিল। এখনো সেই স্বাধীনতার জন্য সাংবাদিকদের লড়াই করতে হচ্ছে। ১১ দফায় জরুরি আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নিবর্তনমূলক আইন বাতিলের কথা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও মৌলিক অধিকারবিরোধী অনেক আইন জারি আছে বিভিন্ন নামে ও মোড়কে। ১১ দফায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন রহিত করার কথা ছিল। আজ কালাকানুন না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করছে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।

কর্মসূচি

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ‘শহীদ আসাদ ও ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। ৩১/এফ তোপখানা রোডে পার্টির কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত আলোচনা সভায় উপস্থিত থাকবেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।

শহীদ আসাদ পরিষদের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৯টায় শহীদ মতিউর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও শপথ পাঠ। বেলা ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা মঞ্চে ‘গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভা।