মহামায়ার পাড়ে শামুকখোলের বাড়ি

মহামায়া হ্রদের পাড়ে এখন প্রায়ই দেখা মেলে শামুকখোলের এমন দলের। মহামায়া হ্রদ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম, ২২ জানুয়ারি। ছবি: ইকবাল হোসেন।
মহামায়া হ্রদের পাড়ে এখন প্রায়ই দেখা মেলে শামুকখোলের এমন দলের। মহামায়া হ্রদ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম, ২২ জানুয়ারি। ছবি: ইকবাল হোসেন।

তখন বিকেল হয়ে গেছে। রোদ  কমে এসেছে। মিরসরাইয়ের মহামায়া হ্রদে ঘুরতে গিয়েছিলাম গত সোমবার। হ্রদের উত্তর পাশের পাহাড়ের ওপর কয়েকটি গাছের ঢালে দেখা মিলল শামুকখোলের। ছোট ছোট দলে ঘুরছে পাখিগুলো। অল্প কিছু দূরত্বের দুটি গাছে ২৫ থকে ৩০টি শামুকখোল এসে বসল। আশপাশের অন্য গাছগুলোতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আরও বেশ কিছু পাখি। কাছাকাছি যেতেই সাঁই সাঁই করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল অন্য গাছে বসতে। 

পাখিদের হুটোপুটির মধ্যে ছবি তোলা ঝক্কির কাজ। এর মধ্যেই মন্দের ভালো কয়েকটা ছবি নেওয়া গেল। নৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, এখানে পাখিগুলো বছর দুয়েক ধরে দেখা যাচ্ছে। সকালে কখন এরা খাবারের খোঁজে উড়ে চলে যায় তা কেউ জানে না। তবে বিকেল হতেই দলে দলে এদের হ্রদের দিকে আসতে দেখি আমরা।
বাংলাদেশের আবাসিক পাখি বিলুপ্তির তালিকা দ্রুত লম্বা হচ্ছে। ঠিক তখন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষিত একটি আবাসিক পাখির বিচরণ বেশি করে চোখে পড়ছে। পাখিটির নাম শামুকখোল (বৈজ্ঞানিক নাম Anastomus oscitans)। শামুক ভেঙে খেতে ওস্তাদ, তাই পাখিটির এই নাম। মাছ, কাঁকড়া, ছোট ছোট প্রাণি, ব্যাঙ ইত্যাদিও আছে খাদ্যের তালিকায়। বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক এই পাখিটি বর্তমানে বন্য প্রাণি আইনে সংরক্ষিত পাখির তালিকায় আছে। এটি দেখতে বকের মতো, তবে ঠোঁট লম্বা ও ভারী। গায়ের রং দুসর-সাদা। মিরসরাইয়ের জলা ভূমিগুলোতে এখন প্রায়ই এদের দল দলে শামুক খুঁজতে দেখা যায়। মহামায়া হ্রদের চারপাশের পাহাড়গুলোর গাছের ডালে স্থায়ী আবাস গড়েছে এরা। ধারণা করা হচ্ছে, মিরসরাইয়ে খাবারের প্রচুর্যই পাখিটিকে এখানে টেনে এনেছে।

শামুকখোল সারসজাতীয় পাখি। পৃথিবীতে দুটি প্রজাতি আছে এদের। একটি হচ্ছে এশীয়, আরেকটি আফ্রিকান। বাংলাদেশে যে পাখিটি দেখা যায়, তা হচ্ছে এশীয় প্রজাতির। আফ্রিকান শামুকখোল দেখতে পুরোটাই কালো। এশীয় শামুকখোলের পালকের সামনের দিকটা কালচে। এই প্রজাতির শামুকখোল বাংলাদেশের রাজশাহীর দুর্গাপুর, নাটোরের পচামারিয়া ও পুটিয়ায়, ফেনী, নওগাঁর সান্তাহার ও মহাদেবপুর, জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেটের হাওর এলাকায় কিছু কিছু দেখা যায়। সব এলাকায় এরা এখন বিপদগ্রস্ত।
পাখি বিশেষজ্ঞ রোনাল্ড হালদার বলছিলেন, একসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন জলাভূমি-সংলগ্ন এলাকায় এই পাখির বিচরণ ছিল। কিন্তু চিংড়ির খাবার জোটাতে বিল থেকে ব্যাপক মাত্রায় শামুক আহরণের কারণে শামুকখোলের সংখ্যা কমে গেছে অনেক। ‘ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত’ বলে চিহ্নিত হলেও এই পাখি এখন খুব কম দেখতে পাওয়া যায়।’

এশীয় শামুকখোল আকারে বেশ বড়সড় জলচর পাখি। প্রাপ্তবয়স্ক একটি পাখির দৈর্ঘ্য কমবেশি ৮১ সেন্টিমিটার হয়। ডানা ৪০ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ১৫.৫ সেন্টিমিটার, লেজ ২০ এবং পা ১৪.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের প্রজননকাল জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে। প্রজননকালে পাখিটিকে একদম সাদা দেখায়। স্ত্রী-পুরুষ পাখি মিলে বাসা তৈরি করে, স্ত্রী পাখি মুরগির ডিমের চেয়ে একটু বড় ৩ থেকে ৫টি ডিম পাড়ে। এরা দলবদ্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে। নিরাপদ মনে হলে এক স্থানে এরা বছরের পর বছর থেকে যায়। মিরসরাইয়ের মহামায়ার পাড়কে হয়তো এমন নিরাপদ বলেই মনে করে প্রকৃতির এই অনন্য সৌন্দর্যের প্রতীক পাখিটি। নৌকার মাঝি বলছিলেন, আগে একটু আওয়াজ পেলেই উড়ে চলে যেত, এখন সহজে যায় না। খুব কাছে গেলে তবেই উড়ে আরেক গাছে গিয়ে বসে। মাছরাঙা, ডাহুক আর পানকৌড়িদের সঙ্গে এখন এই পাখিগুলো দেখে আনন্দ পান পর্যটকেরা।