আলুচাষিরা ক্ষুব্ধ, হতাশ

আলুচাষিরা ক্ষুব্ধ, হতাশ
আলুচাষিরা ক্ষুব্ধ, হতাশ

খেত, মাঠ, উঠোন, হাট—সর্বত্র আলু আর আলু। কিন্তু আলুচাষির মুখে হাসি নেই। কারণ, দাম নেই, ক্রেতাও নেই।
একদিকে নতুন আলু উঠেছে। অন্যদিকে পুরোনো আলু হিমাগারে অবিক্রীত পড়ে আছে। বাজার এতটাই মন্দা যে হিমাগার থেকে আলু বের করার সাহস পাচ্ছেন না কৃষক। আবার নতুন আলু হিমাগারে রাখাও যাচ্ছে না।
ফলে প্রায় তিন মাস সবটুকু শ্রম দিয়ে যে আলু ফলিয়েছেন, সেই আলুই এখন কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তাই দেশের বিভিন্ন স্থানে আলু ফেলে মহাসড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন কৃষক।
তবে কৃষকেরা আলু নিয়ে বিপদে আছেন বলে মনে করেন না কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি বলেন, এক মাসের মধ্যে আলুর দাম বেড়ে যাবে। আলুর ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকেরা বিপদে পড়েছেন বলে মনে করা হলেও, এটা ঠিক নয়।
এ বছর চার লাখ ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর চাষ হয়েছে। ৮৫ লাখ টন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও উৎপাদন হয়েছে ৮৬ লাখ টনের বেশি। অনেক স্থানে এখনো খেত থেকে আলু তোলা হয়নি। তবে বিরূপ আবহাওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে চলতি মৌসুমে আলুখেতেই আলু পচে যেতে দেখা গেছে। চাষিরা বলছেন, ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সারা দেশে এক কোটি ২০ লাখের মতো কৃষক আছেন। এঁদের ৮০ থেকে ৯০ লাখই প্রতিবছর আলু চাষ করেন।
প্রথম আলোর বিভিন্ন জেলার প্রতিবেদকেরা আলুচাষির সঙ্গে কথা বলেছেন। চাষিরা জানিয়েছেন, প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে ছয় থেকে সাত টাকা। আর বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দুই টাকায়। কোথাও কোথাও আরও কম, এক টাকার নিচে। অথচ এই আলু রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়।
মৌসুমের শুরু থেকেই বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলে এক টাকা থেকে সোয়া এক টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করছেন কৃষক। এতে উৎপাদনের সিকি ভাগ খরচও উঠছে না। এ অবস্থায় খেত থেকে আলু তোলায় আগ্রহ নেই কৃষকের। আবার সময়মতো আলু না তোলায় বোরো আবাদও বিলম্ব হতে পারে।
শিবগঞ্জের বন্তেঘরী মহল্লার মনছুর রহমান ২৪ শতাংশ জমিতে গ্রানুলা জাতের আলু চাষ করেছেন। এ জন্য তাঁর খরচ হয়েছে দুই হাজার টাকার বীজ, সাড়ে চার হাজার টাকার সার, দুই হাজার টাকার কীটনাশক, ৪০০ টাকায় সেচ এবং হালচাষ ও শ্রমিকের মজুরিসহ ১০ হাজার ৯০০ টাকা। আলু ফলেছে ৩৬ মণ। মণপ্রতি আলুর উৎপাদন খরচ ৩০২ টাকা। তবে মহাস্থান বাজারে বুধবার প্রতি মণ আলু ৮০ টাকা দরে বিক্রি করে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মাত্রাই গ্রামের আলুচাষি লিটন মিয়া বলেন, ‘এক বিঘা জমিত আলু আবাদে খরচ হচে ১০ হাজার টেকা। বিঘায় ৬০ মণ আলুর ফলন হলেও তা বেচে পাওচি তিন হাজার টেকা। বিঘায় সাত হাজার টেকাই লোকসান যাওচে।’
পুরোনো আলু হিমাগার থেকে বের করেননি, এমন একজন রংপুরের বদরগঞ্জের মধুপুর গ্রামের কৃষক সফিকুল ইসলাম। তিনি জানালেন, গত তিন মৌসুমে ৩৫০ বস্তা আলু হিমাগারে রেখে পরে আর তা বের করেননি। কারণ, বাজারে আলুর ক্রেতা ছিল না। ওই আলুতে তাঁর উৎপাদনসহ পরিবহন খরচ হয়েছিল অন্তত আড়াই লাখ টাকা। পুরোটাই ক্ষতি হয়েছে।
অনেক স্থানেই আলু এখন গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন করছেন বদরগঞ্জের দামোদরপুরের বরকত আলী। এক বস্তা আলুর দাম ৮০ টাকা। আর এক বস্তা ভুষি কিনতে লাগে দেড় হাজার টাকা। তাই কম দামে আলু কিনে গরুকে খাওয়াচ্ছেন তিনি। তারাগঞ্জে গোখাদ্য হিসেবে আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৭৫ পয়সায়।
দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৮০টির মতো হিমাগার আছে, যার বেশির ভাগেই আলু সংরক্ষণ করা হয়। তবে দেশে যেখানে আলুর উৎপাদন ৮৬ লাখ টন ছাড়িয়েছে, সেখানে এসব হিমাগারে সব মিলিয়ে ৪১ থেকে ৪২ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করতে পারে। গত বছর আবার সংরক্ষণ ভাড়া বাড়িয়েছে সংগঠনটি। আগে ৩২০ টাকায় ৮০ কেজি আলুর বস্তা হিমাগারে সংরক্ষণ করা গেলেও এখন চাষিদের খরচ পড়ছে ৩৬০ টাকা। এতেও হিমাগারে গিয়ে আলু সংরক্ষণে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন চাষিরা।
আলুর সংরক্ষণ ব্যয় কম হলে এবং দেশে পর্যাপ্ত হিমাগার থাকলে কৃষকেরা খেত থেকে তুলেই তা বিক্রি করতেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, সরকার চাইলে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে পারে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (বিএডিসি) কিংবা শিল্প মন্ত্রণালয় সারা দেশে হিমাগার গড়ে তুলতে পারে। এটি হলে চাষিরাই লাভবান হবেন।
হিমাগারমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জসিম উদ্দিন মনে করেন, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, ভিজিএফ ও ভিজিডির মতো দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যসহায়তা কর্মসূচিতে চালের সঙ্গে আলু বিতরণ করলে আলুর বিক্রি যেমন বাড়ত, তেমনি আলুচাষিরা ভালো দাম পেতেন।
চাষি এবং সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, আলুভিত্তিক শিল্পকারখানা গড়ে তোলা এবং বিদেশে আলু রপ্তানিতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহী করেও আলু চাষিদের এ হাহাকার কমানো সম্ভব। মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হাবিবুর রহমান এবং তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সমীর চন্দ্র ঘোষের মতও এমন। আলু রপ্তানিকারকেরা এখন ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা পান।
কৃষিমন্ত্রীও সংসদে আরও বলেন, প্রত্যেক বছরই আলুর ফলন নিয়ে একই সমস্যা হচ্ছে। সমস্যা মোকাবিলায় আলু রপ্তানির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চিপস বানানোর জন্য বিশেষ জাতের আলুর চাষ এখন দেশে হচ্ছে। যে কারণে চিপস আমদানি কমে গেছে। সরকারের প্রণোদনায় বেসরকারি উদ্যোগে ৭০০ কনটেইনার আলু রাশিয়ায় যাচ্ছে। দিনে দিনে রপ্তানিও বাড়ছে।