মোগল স্থাপত্যে হাতুড়ির ঘা

পুরান ঢাকার মোগল স্থাপত্যরীতির ঐতিহ্যবাহী হিঙ্গা বিবি মসজিদের ভেঙে ফেলা গম্বুজের একটি অংশ । ছবি: হাসান রাজা
পুরান ঢাকার মোগল স্থাপত্যরীতির ঐতিহ্যবাহী হিঙ্গা বিবি মসজিদের ভেঙে ফেলা গম্বুজের একটি অংশ । ছবি: হাসান রাজা

সুদৃশ্য কারুকাজ খচিত তিনটি গম্বুজ। ভেতরের দেয়ালে দৃষ্টিনন্দন অলংকরণ। সামনে একটি বারান্দা আর অজুখানা। নির্মাণশৈলীতে মোগল স্থাপত্যরীতির পূর্ণ প্রকাশ। হিঙ্গা বিবি মসজিদ। পুরান ঢাকার আরমানিটোলার কে পি ঘোষ রোডে এর অবস্থান।
এই মোগল ঐতিহ্য এখন হাতুড়ির আঘাতে ধূলিসাৎ। তিনটি গম্বুজের দুটি নিশ্চিহ্ন। তৃতীয়টিও আধভাঙা। গত মঙ্গলবার গিয়ে হাতুড়ি-শাবলের নিচে ঐতিহ্যের আর্তচিৎকারই যেন কানে বাজল।
কে পি ঘোষ রোডের ৯৭-৯৮-৯৯ হোল্ডিং নম্বরের হিঙ্গা বিবি মসজিদটিতে কোনো শিলালিপি নেই। ফলে প্রতিষ্ঠার লিখিত সময় জানা গেল না। স্থাপত্য রীতি দেখে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এটি মোগল আমলে নির্মিত। সে হিসেবে বয়স ৩০০ বছরের বেশি। ঢাকায় সেই সময়ের বাসিন্দা কোনো এক হিঙ্গা বিবি মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করে ৩১ কাঠা জায়গাসহ এটি ওয়াক্ফ করে যান।
দখল-বেদখল হয়ে জমি আছে এখন ছয় কাঠা। মসজিদের নামটিও বদলে দিয়ে নাম রাখা হয়েছে ‘মাওলানা মসজিদ’। এখন মূল মসজিদটিই উধাও করে দেওয়া হচ্ছে।
পুরোনো মসজিদে মুসল্লিদের জায়গা হয় না। বহুদিন সংস্কার না করায় ভেতর থেকে সুরকি, পলেস্তারা খসে পড়ছে। ছাদও ধসে পড়ার আশঙ্কা। এসব ‘বাস্তব কারণ’ দেখিয়ে মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটি গত বছর থেকে সম্প্রসারণের কাজ শুরু করে। তবে তা ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রেখে নয়, বরং ভেঙে ফেলে।
মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সাবের আহমেদ ও যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম অকপটে বললেন, বাস্তব প্রয়োজনেই পুরোনো মসজিদটি রাখা গেল না। দুটি সারিতে ৪০-৫০ জনের মতো মুসল্লি নামাজে দাঁড়াতে পারতেন। মসজিদ তো নামাজের জন্য। যদি নামাজই আদায় করা না যায়, তবে সেই ভবন রাখার সার্থকতা কী? আর মসজিদ ভেঙে তো তাঁরা মসজিদই করছেন। অসুবিধা কোথায়?
ওয়াক্ফর জায়গা বেচাকেনা, হস্তান্তর চলে না। তাহলে তাঁরা দখলকারীদের থেকে জমি উদ্ধারে না গিয়ে ঐতিহ্যে হাত দিলেন কেন? তাঁদের বক্তব্য হলো, দখলকারীরা ঘরবাড়ি করে ফেলেছে। আইনি লড়াই করতে গেলে দীর্ঘ সময় ও অর্থের প্রয়োজন। এর চেয়ে ছয় কাঠায় পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করলেই ৩০ কাঠার সমান পরিসর পাওয়া যাবে। সেই কাজটিই করছেন তাঁরা। গত বছর থেকে পুরোনো মসজিদের সামনের অংশে শুরু হয়েছে সম্প্রসারিত নতুন ভবন নির্মাণ। তিনতলা পর্যন্ত উঠে গেছে তা। পুরোনো মসজিদ ভাঙা শুরু হয়েছে চলতি মাসে।
মসজিদের সামনে ও পাশে বেশ খানিকটা জায়গাও আছে। সেখানে ২১টি দোকান ও একটি তিনতলা বাড়ি আছে। এগুলো ভেঙে কি নতুন মসজিদ করা যেত না? কমিটির নেতারা বললেন, এসব থেকে পাওয়া অর্থে মসজিদ পরিচালনার ব্যয় মেটানো হয়। সেসব দিকে না গিয়ে যে কাজটি সহজ ছিল, তাই করছেন তাঁরা। ওয়াক্ফ প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে পুরোনো মসজিদ ভাঙছেন।
ওয়াক্ফ কার্যালয়ে গিয়ে হিঙ্গা বিবি ওয়াক্ফ স্টেট-এর ফাইলে ১৯৭২ সালের আগের কোনো কাগজপত্র পাওয়া গেল না। সবচেয়ে পুরোনো যে নথিটি আছে, সেটি ১৯৭২ সালের ১০ মে তারিখের। উল্লেখ করা হয়েছে, ‘দ্বিতীয় দফা নথি’। এই নথিতে মসজিদের সম্পত্তির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ১৬২২ সহস্রাংশ। অর্থাৎ ১৬ শতাংশের কিছু বেশি।
সংশ্লিষ্ট ওয়াক্ফ সহকারী প্রশাসক মোতাহার হোসাইন খান বলেন, ‘এই ওয়াক্ফ স্টেটটির বহুদিন ধরে কোনো তত্ত্বাবধায়ক ছিল না। সম্প্রতি মসজিদের নতুন কমিটি হয়েছে। তাঁরা জানান, মসজিদটি জরাজীর্ণ, ভেঙে পড়তে পারে। ওয়াক্ফর ওই অঞ্চলের পরিদর্শক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতিবেদন দেন।’
তারপর মেলে নতুন স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি।
তদন্তকারী ঢাকা-২ অঞ্চলের পরিদর্শক আবুল কাশেম বলেন, ‘পরিদর্শনে গেলে আমাকে তাঁরা চাপ দিয়েছিলেন, যেন মসজিদটি ভাঙার ব্যাপারে প্রতিবেদন দেই।’ তবে পুরোনো মসজিদটি রেখেই সামনের অংশে সম্প্রসারণ করা যেত বলে তিনি উল্লেখ করেন।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক আতাউর রহমান জানালেন, হিঙ্গা বিবি মসজিদটি প্রত্নসম্পদের তালিকাভুক্ত নয়। সে কারণে তাঁরা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারছেন না। তবে মসজিদটি ভাঙার সংবাদ পেয়ে তাঁরা পরিদর্শন করেছেন। মসজিদটি না ভেঙে সংস্কার করে সংরক্ষণের জন্য বলেছেন। এ বিষয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসককে লিখিত চিঠিও দিয়েছেন।
নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী স্থপতি তাইমুর ইসলাম বললেন, এখনো মসজিদটি যে অবস্থায় আছে, তা সংরক্ষণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘আমরা ৪০০ বছরের রাজধানী বলে ঢাকাকে নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু ৪০০ বছরের প্রাচীন নিদর্শন বলতে এই শহরে এখন আছে লালবাগ কেল্লা আর ৮-১০টি মসজিদ। আগে মোগল আমলের মসজিদ ছিল ৩০টির বেশি। কাটরা দুটিও প্রায় ধ্বংস।’ তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ আছে প্রত্নসম্পদের পূর্ণ তালিকা করতে হবে। তার আগে কোনো প্রাচীন ভবন ভাঙা যাবে না। অথচ একের পর এক প্রাচীন স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন বললেন, ‘কেবল মসজিদ নয়, পুরোনো সব স্থাপনা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা ও অজ্ঞতা, দখলদারদের চক্রান্ত ও রাজনীতিকদের যোগসাজশে এ কাজগুলো হচ্ছে। যে অবস্থা চলছে, তাতে আগামী কয়েক দশকে ঢাকায় আর কোনো পুরোনো স্থাপত্য নিদর্শন থাকবে না।’