মার্কিন জাতীয় মহাফেজখানা থেকে প্রথম আলো সংগ্রহ করেছে বায়ান্নর মার্কিন দলিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অবমুক্ত করা এসব গোপন দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ সপ্তম কিস্তি
একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার শোধ নিতে মুসলিম লীগ সরকার উপাচার্য অপসারণসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনর্গঠন করার নীলনকশা তৈরি করেছিল। কিন্তু ‘শহীদ ছাত্রদের রক্তমাখা শার্টের স্মৃতি’ নতুন করে তাদের তাড়া করতে পারে, এই আশঙ্কায় সরকার সে নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেনি।
১৯৫২ সালের ১৫ মার্চ এবং ১৪ জুনে পাঠানো দুটি পৃথক বার্তা থেকে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. এস এম হোসেন বাঙালি ছিলেন না। কিন্তু তিনি বাংলা ভাষার আন্দোলন ও তার সমর্থকদের সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।
এস এম হোসেন ১৯৪৮ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৩ সালের ৮ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। মার্কিন কনসাল লিখেছেন, পাকিস্তান সরকার ফেব্রুয়ারির দাঙ্গার জন্য তাঁকেও দায়ী করে থাকে। ১৪ জুনের বার্তায় ব্রিম লিখেছেন, তাঁকে অপসারণ করা হলে সরকারের ভাবমূর্তিতে দাগ লেগে যাবে। শহীদ ছাত্রদের রক্তমাখা শার্ট আবার আন্দোলিত হবে। আর সেটা আসন্ন নির্বাচনের আগে সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে।
১৯৫২ সালের ১৪ জুন আমেরিকান কনসাল গ্রে ব্রিম ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান যে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠনের যে তোড়জোড় আগে শোনা গিয়েছিল, তা এখন বাস্তবায়ন করার কোনো ইঙ্গিত নেই। বেসরকারি সূত্রগুলো অভিযোগ করছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনর্গঠনে হাত দিতে সরকার এখন ভয় পাচ্ছে। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে সরাতে হবে।
মার্কিন কনসাল ব্রিম ওই বার্তায় র্িলখেছেন, ‘কিন্তু যাই হোক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি মরে যায়নি। চেক বংশোদ্ভূত অধ্যাপক ড. নিউম্যান কট্টর কমিউনিস্টবিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাঁকে অপসারণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছেন উপাচার্য। এ জন্য ৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদের একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। এ সময় অধ্যাপক নিউম্যানকে অপসারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এখন একজন মাত্র ব্যক্তি আছেন, যিনি তাঁকে বাঁচাতে পারেন। আর তিনি হলেন ড. আই এইচ জুবেরি (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি)। তিনি ইংরেজি বিভাগের প্রধান এবং প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্পেশাল অফিসার। কিন্তু ওই বৈঠকের সময় তিনি লন্ডনে থাকবেন।’
১৯৫২ সালের ১৫ মার্চ ঢাকার মার্কিন কন্স্যুলেট ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিল যে, ‘নূরুল আমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠন দেখতে চান। তবে সেটা করতে গিয়ে যেন তাঁর রাজনৈতিক ক্ষতি না হয়, সেটা তাঁকে ভাবতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে পাস করাতে তিনি একটি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করেছিলেন। নূরুল আমীন ওই প্রস্তাবে এটা ঢুকিয়েছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বীকার করে নেবে যে, তাদের শিক্ষাঙ্গনে রাষ্ট্রবিরোধী মহলের নাশকতামূলক তৎপরতা রয়েছে। এবং তাদের নির্মূল করার জন্য একাডেমিক কাউন্সিল অনুষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ়তার সঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করছে। সুনির্দিষ্টভাবে কমিউনিজম ও কমিউনিস্ট পার্টির নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু নূরুল আমীন পরে এটা দেখে অবাক হন যে, একাডেমিক কাউন্সিল যে প্রস্তাব পাস করেছে তাতে কমিউনিস্ট বিরোধিতার অংশটি বাদ পড়েছে। উপাচার্য এখন একান্তে স্বীকার করছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তিনি এবং ১০০ জনেরও বেশি শিক্ষক পদত্যাগ করবেন।’
মার্কিন কনসাল অবশ্য ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের এই হুমকিকে কনস্যুলেট গুরুত্ব দিতে নারাজ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই তা নিয়েছেন। সে কারণে প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সমালোচনা করবেন কি না, সে বিষয়ে এখনো তিনি মনস্থির করতে পারেননি।