তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবায় দরকার দক্ষ প্যারামেডিক

গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক l ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে গতকাল বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক l ছবি: প্রথম আলো

তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কমিউনিটি প্যারামেডিক। কমিউনিটি প্যারামেডিকরা মাধ্যমিক (এসএসসি) পাসের পরে দুই বছরের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। দেশের বিদ্যমান কমিউনিটি ক্লিনিকে এসব প্রশিক্ষিত প্যারামেডিকের কাজের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগানো গেলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার স্বাস্থ্যবিষয়ক অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে।

গতকাল বুধবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতে দক্ষ কমিউনিটি প্যারামেডিকের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে এ সভা আয়োজনে সহযোগিতা করে আস্থা প্রকল্প, সুইস কন্ট্যাক্ট। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

বৈঠকে প্রধান অতিথি স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দেশের ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের অবকাঠামো, লোকবল বাড়িয়ে নতুন মডেল পাস করানো হয়েছে। খুব দ্রুত নতুন মডেলের কমিউনিটি ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শুরু হবে। স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে, এখন প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোকবল।

স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে যাঁরা কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) আছেন, তাঁরা উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর তিন মাসের প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন। তিন মাসের এই প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। প্রশিক্ষণ ভালো হলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত সহজ হয়। দুই বছরের প্রশিক্ষণ পাওয়া কমিউনিটি প্যারামেডিকদের দক্ষতাও কাজে লাগানো যেতে পারে। তাই প্যারামেডিকদের কমিউনিটি ক্লিনিকে চাকরির সুযোগ করে দিতে সরকারি নিয়ম পুনর্বিবেচনার বিষয়টিতে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে।

কমিউনিটি ক্লিনিকে প্যারামেডিকদের নিয়োগ দেওয়া হলে তৃণমূল পর্যায়ে মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু হ্রাসসহ স্বাস্থ্য খাতে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে কমিউনিটি প্যারামেডিকদের কমিউনিটি ক্লিনিকে যুক্ত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বৈঠকের শুরুতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের জনবল, কমিউনিটি প্যারামেডিক কোর্স, কোর্সের পাঠ্যক্রম, তৃণমূলে প্যারামেডিকসের ভূমিকা বিষয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুইস কন্ট্যাক্টের আস্থা প্রকল্পের কর্মকর্তা আবুল ফজল মো. এহসানুল হক। তাতে বলা হয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দক্ষ স্বাস্থ্যসেবায় দাতার সংকট রয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ২০১১ সালে কমিউনিটি প্যারামেডিক কোর্স চালু হয়।

মূল বক্তব্যে জানানো হয়, বর্তমানে দেশের ২৭টি ইনস্টিটিউটে কমিউনিটি প্যারামেডিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূলে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিস্তৃত প্যারামেডিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সুইস কন্ট্যাক্ট ‘অ্যাচিভিং সাসটেইনেবিলিটি টুওয়ার্ডস হেলথ কেয়ার অ্যাকসেস (আস্থা)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। নীলফামারী, সুনামগঞ্জ ও পটুয়াখালী জেলায় কাজ করছে আস্থা।

প্যারামেডিকদের কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়োগ দেওয়া গেলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু—দুটিই কমবে বলে মনে করেন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমসিএইচএস অ্যান্ড এলডি-এমসিআরএএইচের পরিচালক মোহাম্মদ শরীফ। তিনি বলেন, তিন মাসের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হাতে প্রসব করানো সম্ভব নয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি প্যারামেডিকদের পাঠ্যসূচিতে পুষ্টি ও বাল্যবিবাহ রোধের বিষয়গুলো যুক্ত করার পরামর্শ দেন।

প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউশনগুলোতে মানসম্মত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন ইউনাইটেড ন্যাশনস পপুলেশন ফান্ডের (ইউএনএফপিএ) বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ মুসা। তিনি বলেন, প্যারামেডিকদের কোর্সটি তাত্ত্বিকের চেয়েও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণভিত্তিক হওয়া জরুরি। প্যারামেডিকদের নিবন্ধন দেওয়া, ইনস্টিটিউটগুলোর দেখভালে একক কর্তৃপক্ষ গঠন করা প্রয়োজন।

প্যারামেডিকদের শিক্ষাক্রমকে আরও সময়োপযোগী করার কাজ চলমান বলে জানান বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম। তিনি বলেন, প্যারামেডিকদের কোর্সে তথ্যপ্রযুক্তিসহ আরও বেশ কিছু বিষয় যুক্ত করে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হচ্ছে।

সিএইচসিপিদের নিয়োগের যোগ্যতায় এইচএসসি পাসের পাশাপাশি এসএসসি পরীক্ষার পরে দুই বছরের প্রশিক্ষণকে যুক্ত করার দাবি জানান আইআরএইচএসসিপিপির সিনিয়র অ্যাডভাইজার জাফর আহ্‌মাদ হাকিম। তিনি বলেন, দুই হাজারের অধিক প্যারামেডিক ইতিমধ্যে কোর্স শেষ করে বেসরকারি পর্যায়ে ও ব্যক্তি উদ্যোগে কাজ করছেন। সরকার চাইলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত এসব প্যারামেডিককে তৃণমূলে কাজে লাগাতে পারে।

 ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর খায়রুল ইসলাম বলেন, তিন মাসের প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক দিয়ে ভবিষ্যতে কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনা ঠিক হবে না। প্যারামেডিকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি উদ্যোক্তা তৈরির অর্থায়নের ব্যবস্থা থাকলে পেশাটি জনপ্রিয় হবে।

সুইস কন্ট্যাক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর অনির্বাণ ভৌমিক বলেন, মাধ্যমিক পাস করে লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছে এমন বড় একটি বেকার শ্রেণি রয়েছে। তাদের চাকরির বাজারে কিংবা স্ব-উদ্যোক্তা হতে প্যারামেডিক কোর্সটি ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদের সচিব জাহিদুর রহমান বলেন, কমিউনিটি প্যারামেডিকেরা তাঁদের নিজেদের এলাকায় প্রশিক্ষণ নিয়ে, সেখানেই স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে প্যারামেডিকদের কাজে লাগানো জরুরি।

প্যারামেডিকরা কোর্স শেষ করার পরে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত থাকেন বলে জানান রাড্ডা প্যারামেডিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এস এম মহিউদ্দিন কামাল। তিনি বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কমিউনিটি প্যারামেডিকদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা কাজে লাগাতে হবে।

 সিপিটিআই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রবিউল করিম বলেন, বয়স্ক ব্যক্তিদের দেখাশোনার জন্য জাপানে ৫ হাজার কমিউনিটি প্যারামেডিক নেওয়া হবে। জাপানে প্রতিবছর এক হাজার প্যারামেডিক পাঠানোর প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে।

মিরপুর ১০ নম্বরের রাড্ডা এমসিএইচ সেন্টারের কমিউনিটি প্যারামেডিক মাশরেকা পারভীন বলেন, যে প্যারামেডিকরা ভালো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, তাঁরা ভালো প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। বাকিরা সেই সুযোগ পাচ্ছেন না। প্যারামেডিকদের আরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে স্বাস্থ্যসেবা দিতে সুবিধা হবে।