৭ বছরেও হলো না শেষ

রাজশাহীতে নির্মাণাধীন সিটি সেন্টার। সম্প্রতি তোলা। ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহীতে নির্মাণাধীন সিটি সেন্টার। সম্প্রতি তোলা। ছবি: প্রথম আলো
>
  • সিটি সেন্টার, দারুচিনি ও স্বপ্নচূড়া ভবন।
  • কাজ নিয়েছিলেন আ. লীগের সাংসদ ও নেতা।
  • জমির কাগজ না থাকায় দুটির নকশাই অনুমোদন হয়নি।
  • ক্রেতারা হতাশ

রাজশাহী শহরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের কাজ সাত বছরেও শেষ হয়নি। একটি ভবন তিন বছরে আর অপর দুটি দুই বছরে শেষ করার কথা ছিল। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে ভবনগুলোর নির্মাণকাজ করছে আওয়ামী লীগের দুই নেতার প্রতিষ্ঠান।

২০০৯ সালে এই তিন ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়ার সময়ই অভিযোগ উঠেছিল, সরকারি দলের নেতারা নির্মাণকাজ ভাগাভাগি করে নিলেন। এ নিয়ে পত্রিকায় খবরও প্রকাশিত হয়েছিল। এখন নির্মাণকাজ ঝুলে থাকায় সিটি করপোরেশন ছাড়াও যাঁরা দোকানঘর নেওয়ার জন্য ছয় বছর আগে বায়না দিয়েছেন, তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ভবন তিনটি হচ্ছে ‘সিটি সেন্টার’, ‘দারুচিনি প্লাজা’ ও ‘স্বপ্নচূড়া প্লাজা’। নগরের সোনাদিঘির পাশে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পুরাতন ভবনের স্থলে হচ্ছে ১৬ তলা বাণিজ্যিক ভবন। নাম দেওয়া হয়েছে সিটি সেন্টার। এই ভবনের কাজটি পায় রাজশাহীর বাগমারার সাংসদ এনামুল হকের মালিকানাধীন নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান ‘এনা প্রপার্টিজ’। অপর দুটি আটতলা ভবনের নকশাই অনুমোদন হয়নি। এগুলোর কাজ পায় রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা শামসুজ্জামান আওয়ালের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শামসুজ্জামান-জেভি।

এসব কাজের জন্য নয়টি দরপত্র বিক্রি হলেও রহস্যজনক কারণে সিটি সেন্টারের জন্য শুধু এনা প্রপার্টিজ এবং অপর দুটি ভবনের জন্য শামসুজ্জামান-জেভি দরপত্র জমা দেয়। তারপরও পুনঃদরপত্র আহ্বান না করে এ দুটি প্রতিষ্ঠানকেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, ১৬ তলা ভবনে সিটি করপোরেশনের ২৫ দশমিক ২৫ শতাংশ অংশীদার থাকবে। আর দুটি আটতলা ভবনের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন পাবে ২৮ শতাংশ করে। নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজ শেষ হলে সিটি করপোরেশন তার অংশের দোকান থেকে এত দিনে ভাড়া পেত।

এদিকে এসব ভবনের দোকান কেনার জন্য বায়না দিয়ে অনেকে হতাশায় ভুগছেন। সাত বছরে নির্মাণপ্রতিষ্ঠানগুলো দোকান বিক্রির কথা বলে কত টাকা সংগ্রহ করেছে, সেই হিসাব জানা যায়নি।

নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার সময় মেয়র ছিলেন এ এইচ এম খায়রুজ্জামান। জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, যতটুকু কাজ হয়েছে তাঁর সময়েই হয়েছে। বর্তমান মেয়র এসে কিছুই করেননি। স্বপ্নচূড়ার কাজ বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ঠিকাদার নাকি গোপনে আরেক ঠিকাদারের কাছে কাজ বিক্রি করে দিয়েছেন। তারপর থেকে এ অবস্থা হয়েছে। নকশা অনুমোদন কেন হয়নি, তা তিনি জানেন না।

বর্তমান মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, দুটি ভবনের একটি তো ‘রুগ্‌ণ শিল্প’। কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ঠিকাদার কোথায় সেটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নকশা অনুমোদনের জন্য কাগজপত্র হালনাগাদ করতে হবে। তারপর অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।

সিটি সেন্টার

চুক্তি অনুযায়ী, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পুরাতন ভবনের স্থলে ১৬ তলা সিটি সেন্টারের পাশের ঐতিহ্যবাহী সোনাদিঘি সংস্কার করে এর পাড়ে মসজিদ, ওয়াকওয়ে, অ্যাম্ফি থিয়েটার, আইটি লাইব্রেরি এবং দিঘির পাড়ের বর্তমান দোকানগুলোর পুনর্বাসনের কাজ করার কথা। মোট ছয় বিঘা জমির ওপর তিন বছরের মধ্যে এই নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল। অথচ সাত বছর পরও সিটি সেন্টারের কাজ শেষ হয়নি।

২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে সিটি সেন্টারের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়। কাজ করতে না পারলেও এই নির্মাণাধীন ভবনের ওপর এনা প্রপার্টিজ ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। সিটি করপোরেশন এতে সায় দেয়নি। এ জন্য বেশ কিছুদিন নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা হয়। এখন অবশ্য নির্মাণকাজ চলছে। তবে এনা প্রপার্টিজ সোনাদিঘি সংস্কার না করে উল্টো এর জায়গা দখল করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ অভিযোগের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে গত সেপ্টেম্বরে তদন্ত হয়। তদন্তে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সোনাদিঘির ভেতরে এনা শূন্য দশমিক ১ হাজার ১৯৪ একর জায়গা ভরাট করে তার ওপর স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছিল। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সিটি করপোরেশন সেই নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়।

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য সাংসদ এনামুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। রাজশাহীতে কর্মরত এনা প্রপার্টিজের কর্মকর্তারা এ নিয়ে কথা বলতে চান না।

দারুচিনি প্লাজা

নিউমার্কেটের কাঁচা বাজার তুলে দিয়ে সেখানে ২ বিঘা জমির ওপর ২ বছরে একটি আটতলা ভবন ‘দারুচিনি প্লাজা’ নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু ৭ বছর পার হলেও এখনো চারতলার কাজই শেষ হয়নি। শুধু দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত বরাদ্দের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

এই ভবনের দোকান নেওয়ার জন্য যাঁরা বায়না দিয়েছেন, তাঁরা হতাশায় ভুগছেন। নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী অঞ্জন কুমার পাল বলেন, ৬ বছর আগে দোকানের জন্য ৪ লাখ টাকা বায়না দিয়েছেন। হস্তান্তরের সময় আরও ২ লাখ টাকা দেওয়ার কথা। এখনো তিনি দোকান বুঝে পাননি। নিউমার্কেটের শিমলা বস্ত্রালয়ের স্বত্বাধিকারী লিটন সাহা বলেন, দারুচিনি প্লাজায় দোকানের জন্য ৬ বছর আগে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন। আর ২ লাখ ১৯ হাজার টাকা বাকি রয়েছে। দোকান প্রস্তুত হয়নি, তারা শুধু টাকা চায়।

পাশের মৎস্য ভবনের মধ্যে ছিল দারুচিনি প্লাজার জমি। এই জমি মুক্ত করে নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। সিটি করপোরেশন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেয়নি বলে এর নকশাও অনুমোদন হয়নি।

স্বপ্নচূড়া

সিটি করপোরেশন ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে ৩১ কাঠা জমির ওপর আটতলা ভবন ‘স্বপ্নচূড়া’ নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২ বছর সময়ের মধ্যে। ভবনটি আটতলা পর্যন্ত উঠেছে, তবে এখন কাজ বন্ধ। পুরো কাজ কবে শেষ হবে কেউ বলতে পারছে না।

জানতে চাইলে শামসুজ্জামান-জেভির স্বত্বাধিকারী শামসুজ্জামান আওয়াল বলেন, স্বপ্নচূড়া প্লাজা আটতলা পর্যন্ত তোলা হয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে পারছে না বলে এর নকশা অনুমোদন হয়নি। হয়তো সেখানে কোনো জটিলতা আছে।

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (আরডিএ) বলছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না পাওয়ায় দারুচিনি ও স্বপ্নচূড়ার নকশা অনুমোদন হয়নি।

শুধু কি রাজশাহীতে? এর আগে রাজধানীর উত্তরায়ও রাজউকের অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের কাজ করতে পারেনি এনা প্রপার্টিজ৷ সেখানে চুক্তি বাতিল করতে হয়েছে। সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরায় ব্যর্থতার পর রাজশাহীতেও সরকারি কাজে এ ধরনের ব্যর্থতা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না৷ আসলে সরকারের লোক হয়ে এ ধরনের কাজ ও আচরণ সরকারের ভাবমূর্তি বড়ভাবেই ক্ষুণ্ন করে৷