তোয়ো ম্রোর ফলের বাগান

পাহাড়ে মিশ্র ফলের বাগানে তোয়ো ম্রো। এক বাগানেই রয়েছে আম, কলা, আপেলকুল, তেঁতুল ও লিচুগাছ। গতকাল বিকেলে বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের বসন্ত ম্রোপাড়ায়। ছবি: প্রথম আলো
পাহাড়ে মিশ্র ফলের বাগানে তোয়ো ম্রো। এক বাগানেই রয়েছে আম, কলা, আপেলকুল, তেঁতুল ও লিচুগাছ। গতকাল বিকেলে বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের বসন্ত ম্রোপাড়ায়। ছবি: প্রথম আলো

বান্দরবান শহর থেকে গাড়িতে চিম্বুক সড়ক ধরে ঘণ্টাখানেক গেলে বসন্ত ম্রোপাড়া। গাড়ি থেকে নেমে মূল সড়ক থেকে পশ্চিম দিকে দেড় কিলোমিটার হাঁটলে চোখে পড়বে বাগান আর বাগান। আম, ড্রাগন ফল, আপেলকুল, লেবু-কত কী! উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢালে এত দিন কেবল জুম চাষ দেখে যারা অভ্যস্ত, এই দৃশ্য তাদের চোখে বিস্ময় জাগায়। 

পাহাড়ের চেহারা এভাবে বদলে দেওয়ার পেছনে রয়েছেন উদ্যমী এক মানুষ। তাঁর নাম তোয়ো ম্রো (৫১)।
পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ বান্দরবানের মেঘছোঁয়া চিম্বুক পাহাড়। এই পাহাড়ের কিছু আগে ১৪ কিলোমিটার নামের এলাকায় পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটি পাড়া। নাম বসন্ত ম্রোপাড়া। শত বছরের পুরোনো এই পাড়ার বাসিন্দা তোয়ো ম্রো চিম্বুক এলাকার মানুষের সনাতন জুমচাষের অভ্যাস পাল্টে দিয়েছেন। শ্রদ্ধা করে তাঁকে স্থানীয় ব্যক্তিরা এখন সম্বোধন করেন তোয়ো মাস্টার নামে।
ম্রোলাং থেকে চিম্বুক পাহাড় ছাড়িয়ে থানচি পর্যন্ত প্রায় ৪০টি ম্রোপাড়া। ১০-১২ বছর আগেও এসব পাড়ার বাসিন্দারা শত ভাগ জুমচাষি ছিলেন। এখন এই এলাকার ৭০ শতাংশ ম্রো ফলবাগানের মালিক। বাগান করে বছরে কয়েক লাখ টাকা আয় করেন এমন মানুষ সেখানে এখন কম নয়। আগে জুমচাষিদের পেটেভাতে জীবন কাটাতে হতো।

তোয়োর বাগান
সম্প্রতি বসন্ত ম্রোপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, কুলবাগান থেকে কুল তুলছেন তোয়ো ম্রো। কাজের ফাঁকেই কথা চলে তাঁর সঙ্গে। জানালেন, তাঁর তিন একর জমিতে আপেলকুল গাছ ৭০০ টি। এ ছাড়া প্রায় ১০ একর জমিতে রয়েছে আড়াই হাজার আমের গাছ। এ ছাড়া প্রায় দুই হাজার ড্রাগন ফলের গাছও আছে বাগানে। চার একর মিশ্র বাগানে লেবু, লিচু, তেজপাতা, আম, পেয়ারাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফলের গাছ।
তোয়ো বলেন, তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে ও মেয়েকে আর্থিক সংকটে পড়ালেখা করাতে পারেননি। এখন দুই ছেলে ময়মনসিংহের একটি মিশনারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। যা আয় হচ্ছে তা বাগানেই বিনিয়োগ করছেন। এখন পরিবারের সব প্রয়োজন মেটাতে পারছেন। এতেই তিনি সুখী।
বংশপরম্পরায় জুমচাষ করে অবস্থার পরিবর্তন হয় না। তাই ২০০৫ সালে বাগান করার সিদ্ধান্ত নেন তোয়ো ম্রো। শুরুতে দেশি ও উচ্চফলনশীল পেঁপে চাষ করে সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হয়। কৃষি বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমবাগান শুরু করেন ২০০৭ সালে। তখন থেকেই পুরোদস্তুর বাগানি বনে গেছেন।

আধুনিক চাষ পদ্ধতি
পাহাড়ের ওপরে বাগান করলে পানি আসবে কোথা থেকে? তোয়ো ম্রো এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন গ্র্যাভিটি ফ্লো সিস্টেম সেচ নামে একটি পদ্ধতি (ওপর থেকে নিচের দিকে পানির প্রবাহ)। এই পদ্ধতিতে ঝরনা থেকে নলের মাধ্যমে পানি এনে স্থানে স্থানে বড় আকারের পানির ট্যাংক বসানো হয়। সেখান থেকে ঢালু পাহাড়ের বাগানে সেচ দেন তিনি।
তোয়ো বলেন, ক্ষতি এড়াতে মিশ্র ফলের বাগান করা হচ্ছে। কোনো কারণে একটি ফলের ক্ষতি হলে যাতে অন্য বাগানে ফলন দিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যায়। তিনি ২০১৪ সাল থেকে আপেলকুল এবং গত বছর থেকে ড্রাগন ফলের চাষ শুরু করেছেন। মাত্র দুই মাস আগে তিনি ড্রাগন ফলের চারা রোপণ করেছেন। এতে খরচ হয়েছে প্রায় চার লাখ টাকা। জুন-জুলাইয়ে ফলন হলে ১০ লাখ টাকা আয় হবে। এ বছর আম, আপেলকুল, ড্রাগন ও অন্যান্য ফল বিক্রি করে ২০-২৫ লাখ টাকা পেতে পারেন বলে তাঁর ধারণা।

তোয়োর ফলবিপ্লব
বসন্তপাড়ার আশপাশে নোয়াপাড়া, ম্রোলাংপাড়া, রেনিক্ষ্যংপাড়া, ক্রামাদিপাড়া, দেওয়াইপাড়াসহ চিম্বুক পাহাড়ের বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে ধারে সব কটি ম্রোপাড়ায় আম, কাঁঠাল, আপেলকুল, কমলা, কলা, আনারসের বাগান দেখা যায়। চিম্বুক পাহাড় এলাকায় বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠীর প্রায় শতকরা ৭০ জনই এখন জুমচাষি থেকে বাগানিতে পরিণত হয়েছেন বলে জানালেন চিম্বুক ফলচাষি সমবায় সমিতির সভাপতি পাসিং ম্রো।
পাসিং বলেন, তাঁদের জরিপমতে চিম্বুক পাহাড়ে এখন বসবাসরত ৭০ শতাংশ ম্রো পরিবার কোনো না কোনো ফলের বাগান করেন। বাণিজ্যিক ফলের বাগান, ফল আহরণ ও বিপণন বিষয়গুলোর পথ দেখিয়েছেন তোয়ো মাস্টার।
বসন্তপাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) চং রেং ম্রো বলেন, তোয়ো ম্রো প্রথম চিম্বুক পাহাড়ে ব্যাপক আকারে বাণিজ্যিকভাবে ফল বাগান শুরু করেছেন। তাঁকে দেখেই মানুষ বাগানের দিকে ঝুঁকেছে। কারও বাগানে কোনো সমস্যা হলে তিনি বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেন।
দেওয়াইপাড়ার রেংরাং ম্রো বলেন, তোয়ো ম্রোয়ে বাগান দেখে তিনি ২০১৪ সাল থেকে বাগান করা শুরু করেছেন। এখন পাঁচ একর আম ও আধা একরের আপেলকুলের বাগান রয়েছে। বাগান করায় আগের চেয়ে তাঁর আয় বেড়েছে।

বাগান থেকে বাজারে
চট্টগ্রামের আড়তদার সাঈম আলম খান ও শহীদ জিয়াউদ্দিন বলেন, চিম্বুক পাহাড়ের ফলবাগানিরা আমের মৌসুমে প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২৫ লাখ টাকার আম, কাঁঠাল, পেঁপে, কমলাসহ নানা ফল তাঁদের আড়তে দিয়ে যান।
চিম্বুক ফলচাষি সমবায় সমিতির সভাপতি পাসিং ম্রো ও সাধারণ সম্পাদক চং রেং ম্রো বলেন, তাঁরা বছরে গড়ে ১৬-১৭ হাজার টন বিভিন্ন জাতের ফল উৎপাদন করেন, যার বাজারদর ১০ কোটি টাকার মতো।
বান্দরবানের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তাদের চোখে তোয়ো ম্রোর পরিচয় একজন ফলবিপ্লবী আর আদর্শ বাগানচাষি হিসেবে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তোয়ো ম্রোকে পুরস্কারও দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি তিনি।
বান্দরবানের উদ্যান উন্নয়নকেন্দ্রের উপপরিচালক রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, স্থানীয় মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিজের বাগান থেকে আয়ের একটা অংশ এখনো খরচ করেন তোয়ো ম্রো।
বাগানচাষিদের কাছে আদর্শ হলেও তোয়ো ম্রো প্রচারবিমুখ বলে মন্তব্য করেন বান্দরবান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, কৃষিতে অবদান রাখার জন্য কোনো পদক বা পুরস্কার নিতে চান না তিনি। এমন মানুষ সমাজে বিরল।