সৈয়দ মাহমুদ প্রধান বিচারপতি

সৈয়দ মাহমুদ হোসেন
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন

পদত্যাগ ও নিয়োগের পূর্বাপর ২০১৭
• ৩ জুলাই: ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় ঘোষণা
• ১ আগস্ট: পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ
• ১৩ সেপ্টেম্বর: রায় বাতিলে আইনি পদক্ষেপ নিতে সংসদে প্রস্তাব পাস
• ২ অক্টোবর: এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার চিঠি
• ৩ অক্টোবর: প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনের দায়িত্ব পান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা
• ১০ অক্টোবর: বিদেশে যাওয়া ও ছুটির মেয়াদ বাড়াতে বিচারপতি সিনহার চিঠি
• ১৩ অক্টোবর: অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন বিচারপতি সিনহা
• ১০ নভেম্বর: কানাডায় যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুর থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান বিচারপতি সিনহা

২০১৮
• ২ ফেব্রুয়ারি: নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন
• জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগ

প্রধান বিচারপতি পদে আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি পদে এই নিয়োগের কয়েক ঘণ্টার মাথায় বঙ্গভবনে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখা করার পরদিন গতকাল শুক্রবার এই নিয়োগ দেওয়া হয়। দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) পদত্যাগ করার ৮৫ দিনের মাথায় ২২তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হলো।

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এর আগে দুবার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সরকার গঠিত বাছাই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর চাকরির মেয়াদ আছে ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আজ শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় বঙ্গভবনে নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন শপথ নেবেন।

প্রথমে এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়া, পরে ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে বিদেশ যাওয়া, এরপর পদত্যাগপত্র পাঠানো—প্রায় চার মাসজুড়ে এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল। এই সময়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি হিসেবে কার্যভার পালন করেন। চলতি বছরের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত চাকরির মেয়াদ থাকলেও গতকাল সন্ধ্যায় তিনি বঙ্গভবনে পদত্যাগপত্র পাঠান।

সরকারের পক্ষ থেকে গতকাল বিকেলে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টার মাথায় ‘অনিবার্য ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে’ পদত্যাগপত্র পাঠান আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা।

জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রথম আলোকে বলেন, এটা যাঁর যাঁর নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মূল্যবোধের বিষয়। অতীতেও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে। যাঁদের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পদে থেকেছেন, বিচারকাজ পরিচালনা করেছেন। আবার কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন।

বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, ওই সাক্ষাতের সময় প্রধান বিচারপতি পদে সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়। যদিও সরকারিভাবে বৃহস্পতিবার রাতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে আরেক মেয়াদে রাষ্ট্রপতি পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন দেশের ইতিহাসে পদত্যাগ করা প্রথম বিচারপতি এস কে সিনহার স্থলাভিষিক্ত হলেন। তাঁর পদত্যাগ নিয়ে গত বছরের শেষ ভাগজুড়ে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক হয়। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দিতে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে এসব পরিস্থিতির সূত্রপাত হয়। বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। ওই পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থী আইনজীবীরা। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রী। অন্যদিকে রায়কে স্বাগত জানায় বিরোধী দল বিএনপি। দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী অবস্থানে নিম্ন ও উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে ২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি নিয়োগ পান বিচারপতি সিনহা। তাঁর চাকরির মেয়াদ ছিল ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। তিনি এখন বিদেশে অবস্থান করছেন।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচার বিভাগে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, তা নতুন প্রধান বিচারপতি কীভাবে পূরণ করবেন, তা আমাদের দেখতে হবে।’ তাঁর মতে, অতীতেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘিত হয়েছে। কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন। এটি তাঁর অধিকার ও এখতিয়ার।

নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এবং জ্যেষ্ঠতম বিচারপতির পদত্যাগের ঘটনায় আইনজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন খুব বেশি ব্যতিক্রমী নয়। তবে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবেন—এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল।’

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে অভিনন্দন এবং বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞাকে আরও বড় অভিনন্দন জানিয়ে শাহদীন মালিক বলেন, ওয়াহ্হাব মিঞার মতো ব্যক্তিদের বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমেই দেশে ন্যায়, সত্য ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগ

বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগের পর বিচারপতি মো. ওয়াহ্হাব মিঞা না বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন—কে হবেন প্রধান বিচারপতি তা নিয়ে নানা জল্পনা–কল্পনা চলছিল। গতকাল বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নিয়োগের মধ্য দিয়ে এর অবসান হলো। কিন্তু আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির মধ্যে জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা গতকালই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে পদত্যাগপত্র দিলেন। গতকাল সন্ধ্যায় একজন ব্যক্তিগত কর্মচারীর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠান। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলে তিনি পদত্যাগ করবেন—এমন গুঞ্জন আগে থেকেই ছিল। বিচারালয়–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের কয়েকজন বিচারপতি পদত্যাগপত্র পাঠানোর পর গতকাল বাসায় গিয়ে ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে দেখা করেন।

সাত বছর আগে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ আপিল বিভাগে চারজন বিচারপতি একসঙ্গে নিয়োগ পেয়েছিলেন। চারজন বিচারপতি ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন। ওই তালিকায় প্রথমে নাম ছিল বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার।

গতকালের নিয়োগ ও পদত্যাগ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিচারপতি এস কে সিনহাকে যখন পদত্যাগ করানো হলো, তখন দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার যে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা উচিত ছিল, তা দেখা যায়নি। ফলে আজ সরকার যখন তাঁকে ডিঙিয়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করল, তখন স্বাভাবিকভাবে আইনজীবী ও জনগণের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তবে তাঁর মতে, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন কখনো বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না।

তবে চলমান এই পরিস্থিতির অবসান ঘটবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের অনেকেই। তাঁরা মনে করেন, আপিল বিভাগে শিগগিরই নতুন বিচারপতি নিয়োগ হবে এবং বিচারব্যবস্থায় আরও গতি আসবে।

জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন টেলিফোনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোকে বলেন, জ্যেষ্ঠতার নীতি অনুসরণ করাই প্রত্যাশিত ছিল, কারণ তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তবে তাঁর প্রত্যাশা বিচার বিভাগের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সব পদক্ষেপই নেওয়া হবে।