বিপন্ন বন টেংরাগিরি

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন টেংরাগিরির অসংখ্য গাছ মরে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ছবি। বরগুনার তালতলী উপজেলায়। ছবি: সাইয়ান
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন টেংরাগিরির অসংখ্য গাছ মরে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক ছবি। বরগুনার তালতলী উপজেলায়। ছবি: সাইয়ান
>• টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
• তীব্র ভাঙনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় এই বনের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে।

পরিবেশ-প্রতিবেশের পরিবর্তনে আয়তন কমছে সংরক্ষিত বন টেংরাগিরির। এই বনাঞ্চলে প্রতিবছর মরছে অসংখ্য গাছ। ১৫ বছর ধরে এই অবস্থা চলছে। কিন্তু প্রকৃতির এই বিপদ থেকে বনটিকে রক্ষায় বন বিভাগের কোনো উদ্যোগ নেই।

পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, টেংরাগিরি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। তেমনি পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এই বনের ভূমিকা অপরিসীম। টেংরাগিরির অস্তিত্ব বিলীন হলে জলবায়ু ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বনের অস্তিত্ব রক্ষায় কোনো উদ্যোগ না থাকাটা দুঃখজনক।

বরগুনার তালতলী উপজেলা থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত বিস্তৃত এই বন। বন বিভাগের খাতায় ‘টেংরাগিরি বনাঞ্চল’ হলেও স্থানীয়ভাবে এটি ‘ফাতরার বন’ নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে এই নামকরণ করা হয়। তখনকার হিসাব অনুযায়ী, বরগুনার বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে চোখজুড়ানো এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর।

১৯২৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই তৎকালীন সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির অপূর্ব মিশ্রণের কারণে এই বনে গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, গরানগাছের সমারোহ। এখানে বসত গড়েছে হাজারো প্রজাতির প্রাণী। অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হওয়ায় এখানে গড়ে উঠেছে সোনাকাটা ইকোপার্ক পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু একের পর এক গাছের মৃত্যু প্রকৃতি ও মানুষের এসব আয়োজনকে ভন্ডুল করতে বসেছে।

বন বিভাগ বলছে, এই বনে গাছের মৃত্যুর কারণ শ্বাসমূলে বালু জমে যাওয়া ও ভূমিক্ষয়। প্রবল ঢেউয়ে উপকূলে পাড় ভাঙছে, গাছের গোড়ার মাটি ও বালু সরে গিয়ে শিকড় শুকিয়ে যাচ্ছে। তীব্র ভাঙনে বনে প্লাবনভূমির পরিমাণ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। এতে এসব শ্বাসমূলীয় গাছ ঠিকভাবে অক্সিজেন নিতে না পারায় পাতা ও কাণ্ড হলদে হয়ে প্রথমে সজীবতা হারায়, পরে মরে বিবর্ণ হয়ে যায়। প্রকৃতিবিদ রেজা খানও এ মত সমর্থন করে বলেন, যদি উপকূলীয় বনে ব্যাপক পলি পড়ে, গাছের শ্বাসমূল ঢেকে যায়, তাহলে সেসব গাছ মারা যাবে।

ডিসেম্বরের শুরুর দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, টেংরাগিরি বনের দক্ষিণ দিকের শেষ সীমানায় সোনাকাটা সৈকতের বালিয়াড়িতে অসংখ্য মৃত রেইনট্রি, কেওড়া ও ছৈলাগাছ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। বঙ্গোপসাগরের প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে আরও অসংখ্য গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড়-বাকড় বের হয়ে গেছে। বালুতে এসব গাছের শ্বাসমূল ঢাকা পড়েছে। গাছগুলোর পাতা ও কাণ্ড হলদেটে হয়ে গেছে। বনের মধ্যে জোয়ারের পানি ঢুকে ভূমির ক্ষয় ত্বরান্বিত করছে। সখিনা, নিশানবাড়িয়া, নলবুনিয়া সংরক্ষিত বনে গিয়েও একই দৃশ্য চোখে পড়ে।

বন বিভাগ বলছে, ১৫ বছর ধরে এই ভাঙন অব্যাহত আছে। বনের ২১ কিলোমিটারজুড়ে প্রতিবছর দ্রাঘিমাংশ ২ সেকেন্ড করেভাঙছে। অর্থাৎ ভাঙনের কারণে ওই এলাকায় সাগর বছরে গড়ে ২৫০ মিটার বনের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। বন বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো শ্বাসমূলীয় বনের গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তর আছে। শুরুতে উপকূলে ভূমি গঠনের পর উড়িগাছ জন্মায়, তারপর ভূমি কিছুটা শক্ত হলে উড়িগাছ মরে গিয়ে কেওড়া-গেওয়া জন্মায়। মাটি আরও শক্ত হলে আগের গাছগুলো মরে গিয়ে সেখানে সুন্দরী, গরানসহ অন্যান্য গাছ জন্মায়। তাই ফাতরার বনে গাছ কেন মারা যাচ্ছে, তা জানতে দ্রুত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রয়োজন। ভাঙনরোধ ও গাছ মরে যাওয়ার বিষয়ে এখনই গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।

বন বিভাগের পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র বলেন, ‘কেন গাছ মরে যাচ্ছে, তা গবেষণার বিষয়। সঠিক কারণ উদ্‌ঘাটনে আমরা গবেষণার উদ্যোগ নেব। তবে আমার ধারণা, লোনা পানিতে প্লাবিত হওয়ায় টেংরাগিরির গাছপালার শিকড় মরে যায়। গোড়ার বালু-মাটি ক্ষয়ে যাওয়াও গাছের মৃত্যুর জন্য দায়ী।’ ভাঙনের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা প্রাকৃতিক কারণ। ভাঙনরোধে আপাতত একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় বাঁশের বেড়া, খুঁটি পুঁতে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলবে। আর মরে যাওয়া গাছ অপসারণ না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কারণ, মরা গাছগুলো ভাঙনরোধে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে।