প্রশ্নফাঁস চলছেই, কমিটি কাজ করছে না

মোবাইল ফোনে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখছে পরীক্ষার্থীরা। গতকাল রাজশাহী পিএন বা‌লিকা উচ্চবিদ্যালয় কে‌ন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো
মোবাইল ফোনে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখছে পরীক্ষার্থীরা। গতকাল রাজশাহী পিএন বা‌লিকা উচ্চবিদ্যালয় কে‌ন্দ্রে। ছবি: প্রথম আলো
>
  • গণিতের প্রশ্নপত্রও ফাঁস।
  • মোট ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার।
  • ৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে।
  • কমিটি এখনো কাজই শুরু করেনি।

আগাম ঘোষণা দিয়ে চলতি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস চলছেই। গতকাল শনিবার গণিত বিষয়ের প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। এই পরিস্থিতি চললেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে করা আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি কাজই করছে না।

কঠিন বিষয় হিসেবে পরিচিত গণিতের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপকতা ছিল আগের সবগুলোর চেয়ে বেশি। কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ থাকলেও গতকাল একটি কেন্দ্রে পরীক্ষার কক্ষেই মোবাইলে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র পাওয়া গেছে। আবার কোথাও সহকারী কেন্দ্রসচিব নিজেই প্রশ্নপত্র কেন্দ্রের বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো কেন্দ্রের সামনে প্রশ্ন নিয়ে ছাত্র-শিক্ষককে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। আবার একটি কেন্দ্রের বাইরে একজনের কাছে মোবাইলে প্রশ্ন ও হাতে উত্তর লেখা ছিল। এসব ঘটনায় পুলিশ গতকাল ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, যশোর, গাজীপুর, নরসিংদী, শেরপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পিরোজপুরে মোট ৩৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

প্রথম দুদিনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু সেই কমিটি এখনো কাজই শুরু করেনি। ফাঁস হওয়া বিষয়ের পরীক্ষা বাতিল হবে কি না, তা এই কমিটির দেখার কথা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এই কমিটির কার্যপরিধি ঠিক করে দেওয়ার কথা।

কমিটির প্রধান কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এখনো কমিটির আদেশই পাননি।

অবশ্য ফাঁস প্রশ্নের পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা কম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এখন তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, পরীক্ষার আগমুহূর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই প্রবণতা তাঁরা রোধ করতে পারবেন না। আবার এভাবে ফাঁস হওয়ায় নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার মতোও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। কারণ, নতুন করে পরীক্ষা নিলেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। তাই প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও পরীক্ষা বাতিলের সম্ভাবনা নেই।

জানতে চাইল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে সব দিক দিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হচ্ছে। একদিকে দেখছি, মন্ত্রণালয় থেকে নানা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যাঁদের এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তাঁদের অনেকে তৎপর হচ্ছেন না। কে বা কারা কোথায় প্রশ্রয় দিচ্ছে, কেন আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না, সেটা বোধগম্য নয়। এ পরিস্থিতি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।’

গতকাল সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় গণিত পরীক্ষা। কিন্তু সকাল ৯টার সামান্য আগে-পরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে যায়, যা পরীক্ষার মূল প্রশ্নের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে। এর আগে অনুষ্ঠিত বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র, ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র এবং ধর্ম বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এবার পরীক্ষায় ২০ লাখ ৩১ হাজার ৮৯৯ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল পরীক্ষা শুরুর আগে গভ. ল্যাবরেটরি স্কুল ধানমন্ডির সামনে থেকে এক পরীক্ষার্থী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে আটক করা হয়। কেন্দ্রের বাইরে তারা মোবাইল ফোনে প্রশ্নের সমাধান দেখছিল। কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক দল তাদের পুলিশে ধরিয়ে দেয়। নিউমার্কেট থানার পুলিশ জানিয়েছে, এই দুজনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) নিয়ে গেছে।

রাতেঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (উত্তর) অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে মোট ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে আজ রোববার বিস্তারিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হবে।

মোবাইলে প্রশ্ন, হাতে উত্তর
রাজশাহী থেকে প্রথম আলোনিজস্ব প্রতিবেদক জানান, গতকাল পরীক্ষা শুরুর আগে নগরের পিএন সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের পাশে কলেজছাত্রী রাবিয়া ইসলাম (১৯) মুঠোফোন থেকে এক পরীক্ষার্থীকে প্রশ্ন লিখে দিচ্ছিলেন। তাঁর নিজের হাতেও প্রশ্নের উত্তর লেখা পাওয়া গেছে। এটি দেখে অন্য অভিভাবকেরা তাঁকে কৌশলে আটকে রেখে পুলিশে খবর দেন। ওই ছাত্রী এক বন্ধুর কাছ থেকে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে সকাল ৯টার একটু পর প্রশ্ন পান।

বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমান উল্লাহ বলেন, আটক ছাত্রীটির মুঠোফোনের প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষার সব নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নই মিলে গেছে।

প্রথম আলোশেরপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল সকাল ৯টা ২০ মিনিটে সোলায়মান হোসেন নামের এক যুবক শেরপুর শহরের মাধবপুর এলাকায় অবস্থিত মডেল গার্লস ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকের সামনে একটি মুঠোফোন নিয়ে অবস্থান করছিলেন। এ সময় তাঁর গতিবিধি দেখে সন্দেহ হলে পুলিশের একজন কনস্টেবল তাঁকে ধরে কেন্দ্রে কর্তব্যরত নির্বাহী হাকিম মো. রায়হানুল ইসলামের কাছে সোপর্দ করেন। পরে সোলায়মানের ব্যবহৃত মুঠোফোন পরীক্ষা করে গণিত বিষয়ের এমসিকিউ অংশের সব প্রশ্ন ও তার উত্তর পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে সোলায়মান জানান, এসব প্রশ্ন ও উত্তর আরেকজন তাঁকে মুঠোফোনে দিয়েছেন। এক পরীক্ষার্থীকে তা দেওয়ার কথা ছিল।

পরীক্ষা কক্ষে মোবাইলে প্রশ্ন
প্রথম আলোগাজীপুর প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নোয়াপাড়া মায়েজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সোহাগ হোসেন পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনের সময় একটি কক্ষে এক ছাত্রের কাছে মোবাইল ফোন দেখতে পান। পরে তার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটি জব্দ করে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাতে গণিতের ‘খ’ সেটের এমসিকিউ প্রশ্ন পাওয়া যায়, তা মূল প্রশ্নের সঙ্গে মিলে গেছে। এ ঘটনায় তিন ছাত্র এবং দুই শিক্ষককে আটক করা হয়েছে। আটক দুই শিক্ষক হলেন চুপাইর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক সঞ্জীব কুমার দেবনাথ ও জাঙ্গালিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া ছয় ছাত্রকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

সহকারী কেন্দ্রসচিবের পকেটে প্রশ্নপত্র
প্রথম আলোশ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, সকাল ১০টা থেকে গণিত পরীক্ষা চলছিল। আধা ঘণ্টায় এমসিকিউ পরীক্ষা শেষের পথে। কিন্তু উপজেলার মাওনা কেন্দ্রের পিয়ার আলী কলেজ কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ১০টার কিছু আগে আমজাদ হোসেন নামের এক সহকারী কেন্দ্রসচিব লিখিত প্রশ্নপত্রের প্যাকেট থেকে একটি প্রশ্নপত্র সরিয়ে নিজের পকেটে রাখেন। এ সময় কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা শ্রীপুর পুলিশের শিক্ষানবিশ উপপরিদর্শক নয়ন ভূঁইয়া ঘটনাটি দেখে ফেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে সহকারী সচিব প্রশ্নপত্রসহ মূল ফটকের বাইরে যেতে চাইলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা তাঁকে অনুসরণ করতে থাকেন। ফটকের বাইরে গিয়ে প্রশ্নপত্রটি অন্য কাউকে হস্তান্তরের চেষ্টা করছিলেন তিনি। এ সময় ওই শিক্ষককে প্রশ্নসহ হাতেনাতে ধরে ফেলেন পুলিশ কর্মকর্তা।

 অভিযুক্ত শিক্ষককে তাৎক্ষণিক কেন্দ্রের সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত আমজাদ হোসেন উপজেলার আলহাজ ধনাই ব্যাপারী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

প্রথম আলোসিলেট প্রতিনিধি জানান, গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নগরের হাউজিং এস্টেট আম্বরখানা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সামনে থেকে দেলোয়ার হোসেন নামের এক কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, দেলোয়ারের মুঠোফোনের ইমো অ্যাপে গণিতের প্রশ্ন পাওয়া গেছে। সকাল সাড়ে ৯টায় গোয়েন্দা সূত্রে পুলিশ জানতে পারে আম্বরখানা এলাকায় প্রশ্ন ফাঁসকারী অবস্থান করছেন।

প্রথম আলোনরসিংদী প্রতিনিধি জানান, নরসিংদীর মাধবদীতে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও উত্তরপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে সরবরাহের উদ্দেশ্যে সমাধান করার অভিযোগে দুই শিক্ষকসহ চারজনকে কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন মাধবদী এসপি ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক মেহেরুন নেসা, বাংলা বিষয়ের শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন, সহকারী লাইব্রেরিয়ান অঞ্জন দেবনাথ ও অভিভাবক মোখলেসুর রহমান। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা।

প্রথম আলোর নবাবগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, সকাল সোয়া ৯টায় নবাবগঞ্জ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের মাঠে পরীক্ষার্থীদের কাছে মোবাইল ফোনে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সময় দুই শিক্ষককে আটক করা হয়। তাঁরা হলেন বক্সনগর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক রনি মিয়া ও বাহ্রা ওয়াছেক মেমোরিয়াল হাইস্কুলের শিক্ষক সোহেল রানা।

এ ছাড়া দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে চারজন, ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে দুজন, পিরোজপুরে তিনজন, যশোরে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা।