কাউন্সিলর কার্যালয়ের পেছনে 'ইয়াবা বার'

ইয়াবা। ফাইল ছবি
ইয়াবা। ফাইল ছবি
>
  • মাদক ব্যবসা চালায় নজু সর্দার
  • সহায়তা করেন কাউন্সিলর রজ্জব আলী
  • আশীর্বাদ স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস মোল্লাহর
  • কাউন্সিলর কার্যালয়ের পেছনে ‘ইয়াবা বার’

নজু সর্দার মিরপুরে মাদকের সবচেয়ে বড় আখড়া চলন্তিকা ও ঝিলপাড়ের কেনাবেচা নিয়ন্ত্রণ করেন। ২০ বছর আগে মিরপুর এলাকায় গাঁজা বেচতেন। এখন ইয়াবাসহ এমন কোনো নেশার উপকরণ নেই, যা তিনি বিক্রি করেন না। চলন্তিকা বস্তিতে তিনি ইয়াবা বিক্রির পাশাপাশি সেবনের ব্যবস্থাও রেখেছেন।

নজু সর্দারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? এমন প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কমপক্ষে তিনটি সূত্র বলেছে, এলাকাবাসী মনে করেন, স্থানীয় কাউন্সিলর রজ্জব আলী এই নজু সর্দারের মাদক ব্যবসার অংশীদার। আর স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহর আশীর্বাদপুষ্ট এই নেতা সব ‘বিপদ-আপদ’ থেকে নজু সর্দারকে আড়াল করে রাখেন।

চলন্তিকায় অভিযান চালানো একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থানীয় কাউন্সিলর তাঁর কার্যালয়ে সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছেন। এলাকার নিরাপত্তার কথা বলে সেটা লাগানো হয়েছে। আসলে উনি দেখেন, পুলিশ ঢুকছে কি না। পুলিশ দেখলেই খবর পৌঁছে দেন। আমরাও অভিযানে গিয়ে ফিরে আসি।’

প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের। একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মাস ছয়েক আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন নিয়ে সেখানে অভিযান পরিচালনা করতে যান। তাঁরাও খালি হাতে ফিরে আসেন। ফিরে আসার পর দেখেন, বস্তিতে ঢোকার মুখে বড় একটি গাছের ভেতর সিসি ক্যামেরা ঝুলছে। তবে তাঁরা ওই সময় চলন্তিকা বস্তির মুখে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। আরও দেখেন, বস্তি থেকে একজন পুলিশ সদস্য হেলেদুলে বেরিয়ে আসছেন।

২০১৬ সালে র‍্যাব-৪ নজু সর্দারকে ধরতে ওই বস্তিতে অভিযান চালিয়েছিল। বৈদ্যুতিক লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে নজুর সহযোগীরা সে সময় তাঁকে বস্তি থেকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। সে সময়ও কাউন্সিলরের কার্যালয় ও চলন্তিকা বস্তির বিভিন্ন স্পটে সিসি ক্যামেরা ছিল।

নজু সর্দারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয় কয়েক দফা। কিন্তু তিনি কথা বলতে চাননি। নজুর প্রশ্রয়দাতা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রজ্জব আলীর বাসা ও কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি বিদেশে আছেন।

তবে স্থানীয় সাংসদ ইলিয়াস আলী মোল্লাহ বলেন, ‘সবাই আমার লোক। সবাই আমার কর্মী। সবাই আওয়ামী লীগ করে। দেখেন, আমি ডিসি সাহেবকে চলন্তিকার কথা বলছিলাম। ডিসি বলছেন, রজ্জবকে বলেন সিসি ক্যামেরা উঠায়া দিতে। আমি খুবই কষ্ট পাইছি। আমি ওরে বলছি, তুই ভাল হইয়া যা।’ তার মানে কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগসাজশে মাদক কেনাবেচা চলছে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ডিসি সাহেব যেহেতু বলছে, উনি ফাইনাল খবর নিয়া নিছে অলরেডি।’

যেভাবে চলে ইয়াবা বার

এলাকার বাসিন্দারা জানান, নজু সর্দার নিজে এখন খুব একটা বের হন না। তাঁর বদলে মাদক কেনাবেচার দায়িত্ব পালন করেন নজুর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা ও বেয়ান ফেলানী। বস্তির ভেতর মাদক কেনাবেচা করে কমপক্ষে ৫০ জন। কে কী করবে, তার কার্যতালিকা ঠিক করে দেন হাজেরা। দলের একটি অংশের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ বস্তির ভেতরে ঢুকছে কি না, তা খেয়াল রাখা। একদল ক্রেতাদের কাছে ইয়াবা বিক্রি করছে আর অন্য দল ঘরের ভেতরে ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। নিরাপত্তার কারণে একই ব্যক্তি একই স্থানে দ্বিতীয় দিন দাঁড়ায় না। তবে তিনজনের অবস্থান মোটামুটি একই রকম। এই তিনজন হলো সোহেল, নাজিমুদ্দীন ও ভান্ডারি। নাজিমুদ্দীন নজুর আপন চাচাতো ভাই। এর বাইরে আরও কয়েকজন বিক্রেতার নাম পাওয়া গেছে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে। তারা হলো ফরিদ, আলম, ভাগ্না রনি (কাউন্সিলর রজ্জবের ভাগনে), ফারুক সর্দার, শাহাৎ, রাসেল ও সাজু। পুলিশ গত ২৯ জানুয়ারি নজুর বস্তি থেকে সুমন ও জসিম নামে দুজনকে ইয়াবা বিক্রির সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে।

চলন্তিকা বস্তিটি মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে পড়েছে। ৩ ফেব্রুয়ারি চলন্তিকা বস্তির শেষ মাথায় পৌঁছে পাঁচ-সাতজন কিশোর ও উঠতি বয়সী তরুণকে দেখা যায়। তাদের হাতে ছিল হলুদ রঙের প্লাস্টিকের ব্যাগ। কোনো ক্রেতা এলে জানতে চাইছিল, তারা ছোট না বড় ইয়াবা চায়। এক ব্যক্তি ছয় শ টাকা দিয়ে দুটি ইয়াবা কেনার পর আরও ১০০ টাকা দিয়ে বস্তির ভেতরে ঢুকে যান। কথা বলে জানা যায়, ঘরের ভেতরে একসঙ্গে ১৫-২০ জনের ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থা আছে। পুরো বিষয়টি বাইরে থেকে তদারক করছিলেন চার-পাঁচজন মধ্যবয়সী নারী। যে ঘরে ইয়াবা সেবন করা হচ্ছিল, তার বাইরে এক সারিতে চা, মুদিখানা, লন্ড্রি, ওষুধের দোকান। পথে শিশুদের আনাগোনা। কাউন্সিলর অফিস গমগম করছিল বস্তির ভেতরে লোকজনের যাওয়া-আসায়। সবকিছুই ঘটছে প্রকাশ্যে এবং স্বাভাবিকভাবে। এক চা–দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিনই এই এলাকার চিত্র এ রকমই থাকে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অসহায়?

নজুর খোঁজে কতগুলো অভিযান হয়েছে—এমন প্রশ্নে পুলিশ বলেছে, প্রতি সপ্তাহে তারা অভিযান চালায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলেছে, তারা প্রতি মাসে অন্তত একবার অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে মাঝে মাঝে দেখেছে, পুরো বাড়ি সুনসান। কখনো কখনো পালানোর সময় পলিথিনে মুড়ে ইয়াবা নর্দমায় ফেলে গেছে বিক্রেতারা। সেগুলো উদ্ধার করেছে পুলিশ বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মাদকের আখড়াটি নারীদের নিয়ন্ত্রণে। এমনও হয়েছে, অভিযানে যাওয়ার খবর পেয়েই তারা চুলায় পানি বসিয়ে দিয়েছে। কাছাকাছি পৌঁছাতেই গরম পানি ছুড়ে দিয়েছে। কখনো আবার অনেক নারী বেরিয়ে এসে অভিযানে যাওয়া কর্মকর্তাদের নাজেহাল করেছেন। ফাঁক দিয়ে নজু সর্দার পালিয়ে গেছেন।

জানা যায়, চলন্তিকা বস্তিটি বড় একটি নর্দমার ওপর গড়ে উঠেছে। নজুর আস্তানাটি টিনের চালার দোতলা। ওই বাড়ির নিচ থেকে নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। নজু তা-ই করে থাকেন।

চলন্তিকার মাদক ব্যবসা বন্ধে তাহলে উদ্যোগ কী? জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস) সৈয়দ তৌফিক উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এবার যৌথ বাহিনী নিয়ে অভিযানে যাব।’ তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এর আগে মোহাম্মদপুরে অভিযান করে এক গডফাদারকে ধরেছিলাম। দিন সাতেক পর তার জামিন হয়ে গেল।’