প্রচারণায় সরগরম আট উপজেলা

খাগড়াছড়ি সদরের ভাইবোনছড়ার নতুন বাগান এলাকায় গণসংযোগ করছেন এক নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী । প্রথম আলো
খাগড়াছড়ি সদরের ভাইবোনছড়ার নতুন বাগান এলাকায় গণসংযোগ করছেন এক নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী । প্রথম আলো

উপজেলা সদর থেকে পাড়ার অলিগলি এখন ছেয়ে গেছে প্রার্থীদের পোস্টারে। বেলা দুইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলছে বিরামহীন মাইকিং। সমানে চলছে প্রার্থীদের গণসংযোগ। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের মিরসরাই ও হাটহাজারী এবং খাগড়াছড়ি জেলার ছয় উপজেলা। চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন ভোটাররাও। করছেন নানা হিসাব-নিকাশ। ১৯ ফেব্রুয়ারি এই আট উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
খাগড়াছড়ি: প্রতীক বরাদ্দের পরপরই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ফুরসত মিলছে না। ভোটাররাও উপভোগ করছেন নির্বাচনী আমেজ। এবারের নির্বাচনে উন্নয়নের চেয়ে স্থিতিশীল পরিবেশ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সরেজমিনে ভোটার ও প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেছে। জেলায় প্রথম দফায় খাগড়াছড়ি সদর, পানছড়ি, মানিকছড়ি, মাটিরাঙা, মহালছড়ি ও রামগড় উপজেলায় নির্বাচন হচ্ছে।
খাগড়াছড়ি সদরের মহাজনপাড়ার ভোটার শিবু চাকমা বলেন, ‘নির্বাচনে এমন প্রার্থীকে ভোট দেব, যিনি এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারবেন। অতীতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সম্প্রীতি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা রক্ষা করতে পারেননি। আমরা শান্তিতে ঘরে বসবাস করার নিশ্চয়তা চাই।’
খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর এলাকার চরণজিৎ ত্রিপুরা বলেন, প্রার্থীরা নির্বাচনের আগে যে প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচনের পর সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে যান। তাঁরা নিজের স্বার্থ রক্ষায় সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতাদের সঙ্গে হাত মেলাতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না।
রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ছয় উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ২৬ জন। খাগড়াছড়ি সদরে চারজন-শানে আলম, চঞ্চুমনি চাকমা, পংচাইরী মগ ও এম রেজাউল করিম। পানছড়িতে চারজন—অনিমেষ চাকমা, সর্বোত্তম চাকমা, বকুলচন্দ্র চাকমা ও জিমি চাকমা। মহালছড়িতে চারজন—ক্যাজাই মারমা, নীলোৎপল খীসা, বিমল কান্তি চাকমা ও সোনারতন চাকমা। মানিকছড়িতে তিনজন—এস এম রবিউল ফারুক, এনামুল হক ও ম্রাগ্য মারমা। রামগড়ে সাতজন—উ শ্যা প্রু মারমা, এ কে এম আলীম উল্লাহ, কাজী মোহাম্মদ সেলিম, চাইথোয়াই চৌধুরী, বেলায়েত হোসেন ভূঁইয়া, রিয়াজ উদ্দিন ও শহীদুল ইসলাম ভূঁইয়া। মাটিরাঙায় চারজন—আবুল কাশেম ভূঁইয়া, তাজুল ইসলাম, আলকাস মিয়া ও শামসুল হক।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী শানে আলম বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে কাজ করায় গত নির্বাচনে জনগণ আমাকে নির্বাচিত করে। আমি গত পাঁচ বছর জনগণের সেই রায় রক্ষায় কাজ করেছি।’
পানছড়ি উপজেলার চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী অনিমেষ চাকমা বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের বরাদ্দ জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে। বিগত সময়ে এই বরাদ্দ কতিপয় সুবিধাভোগীরা ভোগ করেছে। এ ছাড়া উপজেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কাজ করে যাব।’
হাটহাজারী: নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে উঠেছে হাটহাজারী উপজেলায়। রাত-দিন কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ভোট চেয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীরা। প্রার্থীদের কেউ নিজের, কেউ দলীয় কিংবা পারিবারিক সুনাম কাজে লাগিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। ক্ষেত্রবিশেষে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের প্রতিশ্রুতি দিতেও কার্পণ্য করছেন না তাঁরা।
এবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একাধিক ব্যক্তি মনোনয়নপত্র জমা দিলেও দলের পক্ষ থেকে বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মো. ইসমাইলকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। তবে দলের অন্য দুই নেতা-সমর্থক উত্তর জেলা কৃষক লীগের প্রচার সম্পাদক ফয়েজুল ইসলাম (টেলিফোন) ও ধলই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল মনছুর (ঘোড়া) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এদিকে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে রয়েছে বিভ্রান্তি। মাহবুবুল আলম চৌধুরী (কাপ-পিরিচ) ও মো. নাজিম উদ্দীন (দোয়াত-কলম) বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান গত বৃহস্পতিবার টেলিফোনে জানান, দলের পক্ষ থেকে মাহবুবুল আলম চৌধুরীকে (কাপ-পিরিচ) সমর্থন দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আসলাম চৌধুরী বলেছেন, দলের পক্ষ থেকে কাউকে সমর্থনের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ ব্যাপারে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হবে।
হাটহাজারী নাগরিক পরিষদের ব্যানারে প্রচার চালাচ্ছেন নুরুল আবছার চৌধুরী (আনারস)। তাঁকে সমর্থন দিচ্ছেন জাতীয় পার্টি। পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, দলীয় কর্মী-সমর্থকদের নাগরিক পরিষদের প্রার্থী নুরুল আবছার চৌধুরীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে বলা হয়েছে।
প্রার্থী নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও ভোটাররা যোগ্য প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে ভুলবেন না। কেমন প্রার্থী পছন্দ—জানতে চাইলে হাটহাজারী বাজারের ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহিম বলেন, ‘সব প্রার্থীর কথা আলোচনায় কমবেশি আসছে। সবদিক বিবেচনায় যিনি যোগ্য তাঁকেই ভোট দিয়ে জয়ী করব।’
মিরেরহাটের পল্লিচিকিৎসক অরুণ বৈষ্ণব বলেন, সব প্রার্থীর কাছেই এখন ভোটারদের কদর। জনগণের কাজে আসেন, এমন প্রার্থীকেই এবার বেছে নেবেন মানুষ।
নগেন্দ্র মহাজন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রণজিৎ কুমার নাথ বলেন, উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে নির্দলীয়। এ ক্ষেত্রে দলের চেয়ে ব্যক্তির ভালো-মন্দটাই বিচার করবেন ভোটাররা। যাঁদের অতীত ও বর্তমান ভালো, ভোটাররা তাঁদেরই বেছে নেবেন।
মিরসরাই: মিরসরাইয়ে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচারণার কৌশল বদলেছেন প্রার্থীরা। এবার মাঠের প্রচারণার চেয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে ভোট চাওয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে গণসংযোগ করছেন প্রার্থীরা।
গত বৃহস্পতিবার কথা হয় উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. গিয়াস উদ্দীনের সঙ্গে। ওই দিন ভোর থেকে তিনি মিরসরাই পৌরসভার বিভিন্ন বাড়িতে ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গণসংযোগ করেছেন বলে জানান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিরসরাই পৌরসভার মেয়র এম শাহজাহানসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী।
গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘জনগণের যে সাড়া পাচ্ছি, আশা করি, নির্বাচনে আমি বিপুল ভোটে জয়লাভ করব।’
গণসংযোগ নিয়ে কথা হয় মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আতাউর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার তিনি বড় দারোগারহাট থেকে আবুতোরাব এলাকা পর্যন্ত গণসংযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সব জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করছি। ভোটারদের সাড়া পাচ্ছি। জয়ের ব্যপারে আমি আশাবাদী।’ এই সময় তাঁর সঙ্গে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ এবং উপজেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন।
বিএনপির একক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ও চট্টগ্রাম উত্তরজেলা বিএনপির সহসাধারণ সম্পাদক মো. নুরুল আমিন জানান, বৃহস্পতিবার তিনি করেরহাট ও গণকছড়ায় গণসংযোগ করেছেন। একক প্রার্থী হওয়ায় তিনি বিএনপির সব স্তরের নেতাদের সহযোগিতা পাচ্ছেন বলেও জানান। জয়ের ব্যাপারেও তিনি আশাবাদী। তিনি বলেন, যদি প্রশাসনকে ক্ষমতাসীন দল ব্যবহার বা প্রভাবিত না করে, তাহলে তিনিই জয়লাভ করবেন।
এদিকে নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। কয়েক দিন ধরে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নুরুল আলম দাবি করছেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দুজন। আর চট্টগ্রামের বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের নেতা বীর বাহাদুর বলছেন, শেখ হাসিনা মিরসরাইয়ে গিয়াস উদ্দীনকেই নির্বাচন করতে বলেছেন। তবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কিছু নেতা প্রচারণা চালাচ্ছেন আতাউর রহমানের পক্ষে।