পরীক্ষা এখন প্রহসন

পরীক্ষা হলেই প্রশ্ন ফাঁস, তা-ও প্রকাশ্যে আগাম ঘোষণা দিয়ে। এই মাত্রায় প্রশ্নপত্র ফাঁস আগে কখনো হয়নি। আবার প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে এত রকম উদ্যোগও আগে দেখা যায়নি। কিন্তু বাস্তবতা হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনোভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।

পরীক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মত দিয়েছেন, পরীক্ষা ব্যবস্থাটাই এখন প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এর গুরুত্ব বা গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষাকেন্দ্রে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ক্ষোভ ও হতাশায় প্রতিদিন তারা ডুবে যাচ্ছে।

সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১২ সালের পর থেকে পাবলিক পরীক্ষায় অন্তত ৮০ বার (পত্রের) প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিবেদন (২০১৫) অনুযায়ী, চার বছরে বিভিন্ন পরীক্ষায় ৬৩টি বিষয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

পাবলিক পরীক্ষা ছাড়াও ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার অর্ধশতাধিক প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। গত ডিসেম্বরে যুক্ত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। এ কারণে তিন শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করতে হয়।

পরিস্থিতি এতটাই প্রকট হয়েছে যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলছেন, বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো কঠিন কাজ। মন্ত্রণালয় এখন প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) তুলে দিতে চায়।

প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও ফেসবুক বন্ধ রাখা, প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণাসহ এক ডজনের বেশি সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহে এই অভিযোগে গ্রেপ্তারের সংখ্যা প্রায় ১০০।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শিক্ষাব্যবস্থায় যত বেশি পরীক্ষা বাড়ছে, ততই বাড়ছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বাজার। ফেসবুকে একেকটি গ্রুপে কয়েক হাজার সদস্য, একজন পেলেই এদের সবাই পেয়ে যায়, এরপর জ্যামিতির হারে তা বাড়তে থাকে। হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ইমো এবং ভাইবারেও প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আগেও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। তবে পরিস্থিতি কখনো এতটা খারাপ পর্যায়ে যায়নি। এর আগে ১৯৯৬ সালের পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ও তার আগের সরকারগুলোর সময় শিক্ষায় বড় সংকট ছিল নকলের মহোৎসব এবং সময়মতো পাঠ্যবই ছাপতে না পারা। ২০০১ সালে জোট সরকারের সময় নকলের মহোৎসব বন্ধ হলেও বই ছাপা নিয়ে সংকট ছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার সময়মতো পাঠ্যবই দেওয়া নিশ্চিত করে। কিন্তু ওই সময়ের পর থেকে প্রশ্ন ফাঁসের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে।

চলতি এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সঙ্গে ২০ লাখ পরীক্ষার্থী ছাড়াও জড়িত আরও কয়েক লাখ অভিভাবক, আত্মীয়স্বজন ও শিক্ষক। এ ঘটনায় সরকার কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে, প্রশ্ন ফাঁস করে অনেকেই আয়-উপার্জন করছে। কিন্তু বড় ক্ষতিটা হয়ে যাচ্ছে পরীক্ষার্থীদের।

রাজশাহী গবর্নমেন্ট হাইস্কুলের শিক্ষক আজমিরা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, কম মেধাবীরা যখন প্রশ্ন পেয়ে ভালো ফল করবে, তখন তারাই কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে, এতে মেধাবীরা বঞ্চিত হবে। একজন অভিভাবক গতকাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে লজ্জা লাগে, আমার সন্তান এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।’

টানা আট দিন প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় কার্যত হাল ছেড়ে দিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইনের নানা মন্তব্য ও বক্তব্যে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে চলমান এসএসসি পরীক্ষা বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। শাস্তি ও দায়বদ্ধতা না থাকায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে তাঁর মত।

এ বছর আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে। একেক বোর্ডে একেক রকম প্রশ্ন হওয়ায় পাসের হার ও প্রশ্নের ধরনে হেরফের হয়। এই প্রেক্ষাপটে সব বোর্ড একই প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। এখন এক জায়গায় প্রশ্ন ফাঁস হলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তা দ্রুত সারা দেশ ছড়িয়ে পড়ছে।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হিসেবে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা মূলত বহনকারী বা সুবিধাভোগী শিক্ষার্থী। প্রশ্ন কোথা থেকে ফাঁস হয়েছে, তার উৎস চিহ্নিত হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে এখন যা হচ্ছে, তা মূলত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এটা দমনের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের।

প্রথম আলোর হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন পরীক্ষায় জালিয়াতি ও প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে গিয়ে ধরা পড়া ৭০টি ঘটনায় ‘পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে’ মামলা হলেও কারও সাজা হয়নি। ঢাকা বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের মামলায় গ্রেপ্তারই হয়। এরপর জামিন আর খালাসই প্রায় সব মামলার পরিণতি।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রশ্ন ফাঁসের দুটি ধরন আছে। একটি পরীক্ষার দু-এক দিন আগে ফাঁস হওয়া, আরেকটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ফাঁস করা। এবার দুভাবেই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের দুটি পাবলিক পরীক্ষা চলে আসছিল যুগ যুগ ধরে। বর্তমান সরকারের সময়ে আরও নতুন দুটি পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয়। দেশের একজন শিক্ষাবিদও এখন পর্যন্ত ওই দুটি পাবলিক পরীক্ষার পক্ষে মত দেননি। সরকারের ওপর মহলের ইচ্ছায় এই পরীক্ষা চালু করা হয়। শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যমের সমালোচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষা দুটি বাতিল করতে চাইলেও ওপর মহলের নির্দেশে পরীক্ষা দুটি বহাল রাখা হয়েছে।

পরীক্ষা-বাণিজ্যের সঙ্গে এত দিন যুক্ত ছিল কোচিং সেন্টার, নোট-গাইড বা অনুশীলন বই। নতুন যুক্ত হয়েছে প্রশ্ন ফাঁস, যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষক, কোচিং সেন্টার, ছাত্র, ছাত্রসংগঠন বিশেষ করে সরকারি ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মী। এখানে টাকার গন্ধ থাকায় প্রশ্ন ফাঁস বাণিজ্য রমরমা হয়ে উঠেছে।