অর্থ পাচার: কোনো ব্যবস্থাই কেউ নেয়নি

  • প্যারাডাইস, পানামাসহ বিভিন্ন তালিকায় ৮৭ বাংলাদেশি নাগরিকের নাম এসেছে।
  • দুদক বা বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

পানামা, অফশোর ও প্যারাডাইস পেপারসে বিভিন্ন সময়ে নাম আসা বাংলাদেশিদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকারের কোনো সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে পাওয়া তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তারা জানিয়েছে। সেসব তথ্যের সূত্র ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব মূলত দুদকের। আর দুদক বলছে, তারা বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের জোট দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) ‘প্যারাডাইস পেপারস’-এর সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকায় ২০ বাংলাদেশির নাম এসেছে। তাঁরা দক্ষিণ ইউরোপের দ্বীপরাষ্ট্র মাল্টায় অফশোর কোম্পানি খুলেছেন। এসব কোম্পানি খুলে তাঁরা সেখানে কী ব্যবসা করেছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য অবশ্য আইসিআইজে প্রকাশ করেনি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচারের জন্যই মূলত এসব কোম্পানি খোলা হয়।
এখন পর্যন্ত তিনটি তালিকায় ৮৭ জন বাংলাদেশি ব্যক্তির নাম এসেছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত পানামা পেপারসে ২৪ জন বাংলাদেশির নাম এসেছিল। এরপর অফশোর লিকসে ছিল ৩২ জনের নাম। এরপর সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে বের হয় প্যারাডাইস পেপারস নামে নতুন কেলেঙ্কারি। তখন প্রকাশিত হয়েছিল ১১ ব্যক্তির নাম। এরপর প্যারাডাইস পেপারসের মাল্টা কেলেঙ্কারির অংশ হিসেবে পাওয়া গেল ২০ জনের নাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের বিভিন্ন তালিকায় ইতিমধ্যে যেসব বাংলাদেশি নাগরিকের নাম এসেছে, তাঁদের বিষয়ে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দুদকে পাঠানো হয়েছে। এ জন্য বিএফআইইউ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য নিয়েছে। সম্প্রতি যেসব নাম এসেছে, সেগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে তথ্য দুদকের কাছে পাঠানো হবে। আবু হেনা মো. রাজী হাসান আরও বলেন, এসব নাগরিকের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সেই এখতিয়ার দুদকের।

এসব বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ব্যক্তির নাম দুদকের নজরে এসেছে, এগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রোববার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, বিদেশে কোম্পানি খোলা দোষের কিছু নয়। যে দেশে কোম্পানি খোলা হয়েছে বা আয়টা যদি সেই দেশের বা অন্য কোনো দেশের হয়, তাহলে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে এসব অর্থের উৎসদেশ বাংলাদেশ। তার মানে টাকাটা বাংলাদেশ থেকেই গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কী করে এত টাকা গেল? সহজ উত্তর, পাচার হয়েছে। এ ধরনের অপরাধ দেখার দায় বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাদের গোয়েন্দা ইউনিট আছে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

চারজনের ঠিকানায়
আইসিআইজিতে প্রকাশিত সূত্র ধরে গতকাল চারজন ব্যক্তির ঢাকার ঠিকানায় যান এ প্রতিবেদক। তাঁরা হলেন মাহতাবা রহমান, ফারহান আকিবুর রহমান, আমানুল্লাহ চাগলা ও ফজলে এলাহী চৌধুরী।
আইসিআইজের তালিকায় মাহতাবা রহমানের নাম এসেছে সেলকন শিপিং কোম্পানি লিমিটেড নামের একজন শেয়ারধারী হিসেবে। তালিকায় উল্লেখিত বনানী ডিওএইচএসের ৬ নম্বর সড়কের বাসায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে ওই বাড়িতে পাওয়া যায় মাহমুদুর রহমানকে, যাঁর নাম সিঙ্গাপুরের নাগরিক হিসেবে প্যারাডাইস পেপারসের তালিকায় আছে। তিনি নিজেও সেলকন শিপিং কোম্পানির একজন পরিচালক। মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব তালিকা বোগাস। কোথা থেকে কীভাবে এ তালিকায় আমার নাম ও বাসার ঠিকানা এল জানি না। বিষয়টি আমার জন্য অপমানজনক।’
মাহতাবা রহমানের বিষয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘তিনি আমার সাবেক স্ত্রী। ২০০৩ সালেই তাঁর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন কোনো যোগাযোগ নেই।’ তিনি আরও বলেন, মিরপুরে এমবিএম গার্মেন্টস নামে তাঁর একটি তৈরি পোশাক কারখানা আছে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ছেলে ব্যবসা দেখাশোনা করেন।
আইসিআইজের তালিকায় ফারহান আকিবুর রহমানের নাম এসেছে ইন্ট্রেপিড গ্রুপের একজন শেয়ারধারী হিসেবে। গতকাল বিকেলে গুলশানের ৫১ নম্বর সড়কের বাসার ঠিকানায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। বাড়িটির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দুজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফারহান আকিবুর রহমান বাসার বাইরে আছেন। কখন ফিরবেন তা বলে যাননি।
বারিধারা ডিওএইচএসের ৮ নম্বর সড়কের আমানুল্লাহ চাগলার ঠিকানায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মাল্টায় ২০০৯ সালে পদ্মা টেক্সটাইল নামক কোম্পানির নিবন্ধন করেন আমানুল্লাহ চাগলা। বাসার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা একজন ব্যক্তি বলেন, তিনি এখন বাসায় নেই। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর ওই ব্যক্তি আমানুল্লাহ চাগলা কোথায় আছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি বাসায় ফিরলে সাংবাদিক আসার বিষয়টি তাঁকে জানানো হবে বলে জানান ওই ব্যক্তি।
আইসিআইজের তালিকায় থাকা আরেক বাংলাদেশি ফজলে ইলাহী চৌধুরীর ঠিকানা দেওয়া বারিধারা ডিওএইচএসের ৭ নম্বর সড়কের একটি বাসা। ওই বাসায় গিয়ে জানা যায়, তিনি এ বাসায় থাকেন না। তাঁর দেওয়া ঠিকানায় দীন মোহাম্মদ নামের আরেক ব্যক্তি থাকেন। ২০১৬ সালে মাল্টায় নিবন্ধিত ডায়নামিক এনার্জি হোল্ডিংসের পরিচালক হিসেবে ফজলে ইলাহী চৌধুরীর নাম এসেছে আইসিআইজের তালিকায়।