খালেদার জন্য আপিলের প্রস্তুতি

কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
কারাগারের পথে খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
  • রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি পেয়েছেন আইনজীবীরা।
  • আদালতের পর্যালোচনা: ‘তাঁরা অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন’

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি পেয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। গতকাল সোমবার বিকেলে ১ হাজার ১৬২ পৃষ্ঠার প্রত্যয়িত অনুলিপি (মূল রায় ছিল ৬৩২ পৃষ্ঠার) তাঁরা হাতে পান। এরপরই তাঁরা উচ্চতর আদালতে আপিলের প্রস্তুতি শুরু করেন। আজ মঙ্গলবার তাঁরা আপিল দায়ের করবেন বলে জানা গেছে।

৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। এর ১১ দিন পর গতকাল আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রায়ের প্রত্যয়িত অনুলিপি পেলেন। রায়ে খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানসহ পাঁচজনকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন। তারেক রহমানসহ পাঁচজনকে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা ৮০ পয়সা জরিমানার আদেশও দেন আদালত। রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়।

অনুলিপি পাওয়ার পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তিনি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা ও রায় পর্যালোচনা করে আপিল দায়ের করবেন। এরপর তাঁরা খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদন করবেন।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি রায়ের অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠিয়ে দেবেন। এরপর তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন।

রায়ের পর্যালোচনা অংশে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়াসহ অন্য আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে বা অন্যদের অবৈধভাবে লাভবান করার উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি এতিম তহবিলের অর্থ নামসর্বস্ব জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে স্থানান্তর করেন কিংবা করার কাজে সহায়তা করেন। ফলে এই মামলার ছয়জন আসামির প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন। এ কারণে আদালত মনে করেন, তাঁরা রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন। অর্থনৈতিক দুর্নীতি রাষ্ট্রের অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে এবং এর বাজে প্রভাব সমাজের প্রতিটি স্তরে সংক্রমিত হয়। সে কারণে তাঁদের সর্বোচ্চ সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। কিন্তু আসামিদের বয়স, সামাজিক অবস্থান ও আত্মসাৎকৃত টাকার পরিমাণ বিবেচনা করে তা দেওয়া হয়নি।

পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ইউনাইটেড সৌদি কমার্শিয়াল ব্যাংকের মাধ্যমে আসা ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলারের ডিডি খালেদা জিয়া গ্রহণ করেন। ফলে ওই টাকা তাঁর মালিকানায় আসে। এরপর ওই টাকা সোনালী ব্যাংকের ৫৪১৬ নম্বর হিসাবে রাখা হয়। আরও পরে ওই টাকা স্থায়ী আমানত করে রাখার ফলে টাকার ওপর তাঁর স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই টাকা যখন দুই ভাগ করা হয় তখন তাঁর সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর মাধ্যমে বেসরকারি দুটি ট্রাস্টের অনুকূলে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে তিনি ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়েন (ক্রিমিনাল মিস-অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন অব প্রোপার্টি)। কেননা, সরকারি এতিম তহবিলের টাকা দেশে প্রতিষ্ঠিত এতিমখানায় বিধিমোতাবেক ব্যয় করা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে সেই অর্থ নামসর্বস্ব জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অনুকূলে স্থানান্তর করেন। আজ অবধি ওই নামে কোনো ট্রাস্টের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ট্রাস্টের ঠিকানা ৬, শহীদ মইনুল রোড, ঢাকা সেনানিবাস কিংবা বগুড়ার গাবতলী উপজেলার দাড়াইল মৌজায় ট্রাস্টের অস্তিত্ব নেই। ১৯৯৩ সালে ১৭টি দলিলের মাধ্যমে কেনা ২ একর ৭৯ শতাংশ জমি আজ অবধি ধানি জমি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে আইন লঙ্ঘন হয়েছে। সে কারণে তিনি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। কেননা, খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তিনি স্বীকৃতমতেই সরকারি কর্মচারী।

সাজাপ্রাপ্ত অপর চারজন হলেন বিএনপির সাবেক সাংসদ কাজী সালিমুল হক, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ভাগনে মমিনুর রহমান। তাঁদের মধ্যে কাজী সালিমুল ও শরফুদ্দিন কারাগারে এবং বাকি দুজন পলাতক রয়েছেন।

পর্যালোচনায় বলা হয়, আসামিপক্ষ দাবি করেছে যে ট্রাস্টের সঞ্চিত অর্থ সুদাসলে বেড়ে ৬ কোটি টাকার বেশি হয়েছে। কোনো টাকা খরচ হয়নি। ফলে সম্পদের অপব্যবহারও হয়নি। কিন্তু সরকারি অর্থ অনির্ধারিত সময় ধরে ব্যয় না করে আটক রাখা দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নথিতে রক্ষিত কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বলা হয়েছে, আসামি তারেক রহমান ও মমিনুর রহমান সোনালী ব্যাংকের গুলশান নিউ নর্থ সার্কেল শাখার এসটিডি ৭ নম্বর হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করে প্রাইম ব্যাংকের গুলশান শাখায় রাখেন। পরে প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী সালিমুল হক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই টাকা নিউ ইস্কাটন শাখায় স্থানান্তর করেন এবং বিভিন্ন কৌশলে ওই টাকা আসামি শরফুদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত হিসাবে নেন। প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিলে টাকা আসে ১৯৯১ সালে। আর ট্রাস্ট গঠিত হয় ১৯৯৩ সালে। এতিম তহবিলের জিম্মাদার ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এর ফলে ওই অর্থের তিনিই ছিলেন কাস্টডিয়ান। কিন্তু তিনি সরকারি বিধিবিধান মোতাবেক ওই টাকা ব্যয় করেননি।