অবৈধ সিসা কারখানা আবার চালু

>
অবৈধ সিসা কারখানায় গত রোববার দুপুরে কাজ করছেন এক শ্রমিক।  ছবি: প্রথম আলো
অবৈধ সিসা কারখানায় গত রোববার দুপুরে কাজ করছেন এক শ্রমিক। ছবি: প্রথম আলো
• ভ্রাম্যমাণ আদালত ৭ নভেম্বর সিসা কারখানাটি উচ্ছেদ করেন।
• ডিসেম্বরে পুনরায় সেটি চালু করা হয়।
• ধোঁয়ায় অতিষ্ঠ এলাকাবাসী।

যশোরের অভয়নগর উপজেলায় সিদ্দিপাশা গ্রামে ভৈরব নদের তীরে অবৈধভাবে গড়ে তোলা সিসা কারখানাটি উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালত গত ৭ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে সেটি উচ্ছেদ করেন। ডিসেম্বরে পুনরায় সিসা কারখানা চালু করা হয়েছে। ফলে ওই সিসা কারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্যে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

অভয়নগর উপজেলার শেষ প্রান্তের গ্রাম সিদ্দিপাশা। গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব নদ। এ নদ থেকে বেরিয়ে গেছে মুজুতখালী খাল। খালটির উৎপত্তিস্থলের পাশে নদের পারে সিসা কারখানার অবস্থান। সিসা কারখানার কিছুটা দূরে সিদ্দিপাশা গ্রামের সোনাতলা ভদ্রপাড়া ও গাজিপাড়া। ওই দুই পাড়ায় দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস।
গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানার তিন পাশে বাঁশবাগান। এক পাশে ভৈরব নদ। কারখানার মেঝেতে ইট বিছানো রয়েছে। তার ওপর ইটের গোলাকৃতির বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। ওপরে সিমেন্ট-বালুর ঢালাই দেওয়া হয়েছে। এর ঠিক মাঝখানে চুলার মতো একটি গর্ত করা হয়েছে। কিছুটা দূরে একটি ডিজেলচালিত শ্যালো ইঞ্জিন রাখা আছে। এ ইঞ্জিন থেকে একটি পাইপ ওই গর্ত পর্যন্ত চলে গেছে। পাশে অনেকগুলো ইজিবাইকের ব্যাটারির খোলস বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। আগের রাতের সিসা তৈরির ছাপ রয়েছে কারখানায়। কারখানা থেকে পরিত্যক্ত ইজিবাইকের পরিত্যক্ত ব্যাটারির খোলস আলাদা করছিলেন চারজন শ্রমিক। তাঁদের হাতে মোজা পরা। শ্রমিক সুশান্ত দাস বলেন, ‘খুব ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও পেটের দায়ে এ কাজ করতে এসেছি। আমি দিনে ব্যাটারির খোলস ছাড়ানোর কাজ করি। চার-পাঁচজন শ্রমিক রাতে ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা বের করে।’ আরেক শ্রমিক তাজিয়া বেগম বলেন, ‘দিনে আড়াই শ টাকা মজুরিতে শ্রমিকের কাজ করি। স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে হাতে মোজা পরে নিয়েছি।’ শ্রমিক রুবেল গাজী বলেন, ‘পরিত্যক্ত ব্যাটারির কোষগুলো সিমেন্টের মতো জমাট বেঁধে যায়। চুলার মধ্যে কাঠ ও কয়লা দিয়ে পরতে পরতে অ্যাসিডমিশ্রিত জমাট বাঁধা বর্জ্য সাজানো হয়। এরপর আগুন ধরিয়ে দিয়ে পাইপের মাধ্যমে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে বৈদ্যুতিক পাখা দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বাতাস দেওয়া হয়। কাঠ ও কয়লা পুড়ে একটি আগুনের কুণ্ডলীর সৃষ্টি হয়। সিসা পুড়ে তরল হয়। এরপর একটি লম্বা চামচ দিয়ে বর্জ্য সরিয়ে সিসা লোহার কড়াইতে রাখা হয়। ঘন ধূসর ধোঁয়া চিমনি দিয়ে বের হয়ে যায়। সিসা চকচক করে। দিনের বেলা সিসা ও বর্জ্য চেনা যায় না। এ জন্য রাতে সিসা গলানো হয়।’
বিষয়টি নিয়ে গ্রামের কেউই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি। তাঁরা বলেন, গ্রামের জিয়াউর রহমান মোল্যা প্রায় তিন বছর আগে কারখানাটি গড়ে তোলেন। রাতে কারখানায় ইজিবাইকের পরিত্যক্ত ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা বের করা হয়। রাতে যখন ব্যাটারি পোড়ানো হয়, তখন গোটা এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সকালে বিভিন্ন স্থানে সাদা সাদা বর্জ্য পড়ে থাকে। তাঁরা বলেন, জিয়াউর রহমান মোল্যা দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। এ জন্য তাঁরা ভয়ে কিছু বলতে পারেন না। তাঁরা জানান, গত ৭ নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে সিসা কারখানাটি উচ্ছেদ করেন। আদালত এ সময় কারখানার যন্ত্রপাতিও জব্দ করেন। এরপর কিছুদিন কারখানাটি বন্ধ ছিল। গত ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে নতুন যন্ত্রপাতি এনে পুনরায় কারখানাটি চালু করা হয়েছে।
সোনাতলা ভদ্রপাড়া পাড়ার একজন গৃহবধূ বলেন, ‘রাতে যখন কারখানাটিতে সিসা তৈরি করা হয়, তখন চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। কারখানার মালিক খুবই দুর্ধর্ষ প্রকৃতির। ভয়ে কিছুই বলতে পারি না।’
গাজিপাড়ার একজন কৃষক বলেন, ‘কারখানার ধোঁয়া, উৎকট গন্ধ ও সাদা বর্জ্যের কারণে এলাকার অনেকেই হাঁপানি, কাশি, মাথা ব্যথাসহ নানা রোগে ভুগছে। নভেম্বর মাসে প্রশাসন কারখানাটি ভেঙে দিয়েছিল। কয়েক দিন মাত্র বন্ধ ছিল। আবার আগের মতো কারখানাটি চলছে।’
সিসা কারখানাটির মালিক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘ভৈরব নদের তীরে জায়গা কিনে কারখানাটি তৈরি করেছিলাম। কারখানা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ওইখানে আমার কিছু মালামাল রয়েছে। আমার খুলনা জেলায় আরও কয়েকটি সিসা কারখানা রয়েছে। ওই মালামাল সেই সব কারখানায় নিয়ে যাচ্ছি। এ জন্য কয়েকজন শ্রমিক কাজ করছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর, যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিষয়টির খোঁজ নিচ্ছি। কারখানাটি উচ্ছেদ করা হবে।’
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম এম মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘সিদ্দিপাশা গ্রামে ভৈরব নদের তীরে গড়ে তোলা অবৈধ সিসা কারখানা গত নভেম্বর মাসে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এ সময় সিসা তৈরির সরঞ্জামও জব্দ করা হয়। পুনরায় কারখানাটি চালু করা হয়েছে—এখন পর্যন্ত এমন কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বিষয়টি খোঁজ নেওয়া হবে। কারখানাটি চালু করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত বছরের ১৮ মে প্রথম আলোতে ‘ধোঁয়া ও বর্জ্যে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী/ যশোরে ভৈরবের তীরে অবৈধ সিসা কারখানা’ এবং ১৬ আগস্ট ‘ভৈরবের তীরে অবৈধ সিসা কারখানা চলছেই’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৭ আগস্ট ‘নদের তীরে সিসা কারখানা, অবিলম্বে উচ্ছেদ করুন’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। গত ৭ নভেম্বর ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে সিসা কারখানাটি উচ্ছেদ করেন।