বাংলা সাইনবোর্ডে গরজ নেই

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, দোকানপাটের বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। ছবি: প্রথম আলো
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, দোকানপাটের বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। ছবি: প্রথম আলো
>
  • বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা।
  • আইন বলছে, সব নামফলক ও সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে।
  • এ নিয়ে আদালতের আদেশও আছে।
  • উদাসীন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে দাঁড়িয়ে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালে বোঝার উপায় থাকে না, এটি বাংলা ভাষাভাষী একটি দেশের রাজধানী শহর। অধিকাংশ সাইনবোর্ড বড় বড় ইংরেজি হরফে লেখা। নতুন ঝাঁ-চকচকে রেস্তোরাঁগুলোর একটিরও নাম বাংলা শব্দ দিয়ে নয়, সাইনবোর্ডেও বাংলা বর্ণের ছিটেফোঁটা নেই।

গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মিরপুর, মগবাজার, পল্টন এলাকায় একই চিত্র: ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, দোকানপাটের বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। অথচ আইন বলছে, সব নামফলক ও সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে হবে। এ নিয়ে আদালতের আদেশও আছে। তবে যারা এই আইন প্রয়োগ করবে, সেই সিটি করপোরেশন ভবনের আশপাশের অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও ইংরেজিতে লেখা।

আলগা বাংলা, নিচে বিদেশি বর্ণ
বছরজুড়ে দুই সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগ দেখা না গেলেও অতিসম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পত্রপত্রিকায় একটি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার নির্দেশ দিয়েছে। কয়েক দিন ধরে তারা ভ্রাম্যমাণ আদালতের কিছু অভিযানও পরিচালনা করছে। সেটির ফলাফল দেখতে গত সোমবার গুলশান ১ ও ২ নম্বর এলাকা ঘুরলে দেখা যায়, কিছুটা বদলেছে সাইনবোর্ডের চেহারা। কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের পুরোনো ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডের ওপরে অস্থায়ী ব্যানার টানিয়েছে। ব্যানারে বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা হয়েছে।

গত সোমবার দেখা যায়, গুলশানের ইমেজ ফার্নিশিং অ্যান্ড লাইটিং, উইভার্স, নিউ ক্ল্যাসিক ফেব্রিকস প্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজি হরফে লেখা সাইনবোর্ডে ওপরে বাংলায় লেখা ব্যানার টানিয়েছে। ব্যানারের নিচ দিয়ে মূল সাইনবোর্ডটিও দেখা যাচ্ছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বিষয়টি জানতে পেরেই তারা বাংলায় ব্যানার টানিয়েছে। তাদের দাবি, সাইনবোর্ড বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক বিষয়টি তাদের জানা ছিল না।

গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বরে অবস্থিত ফুজি কালার ফটো ওয়ার্ল্ডের ইংরেজি সাইনবোর্ড ঢেকে দিতে এর ওপরে সাদা কাগজ সাঁটানো হয়েছে। সাদা কাগজের এক পাশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ইংরেজি হরফে লেখা ‘স্টু’, আরেক পাশ দিয়ে ‘ফু’ শব্দগুলো।

গুলশানে কেনাকাটা করতে আসা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইকবাল হোসেন বলেন, ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বাংলায় সাইনবোর্ড থাকলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। প্রয়োজন হলে ব্যবসায়ীরা বাংলার পাশাপাশি সাইনবোর্ড, ব্যানারে ইংরেজিতেও প্রতিষ্ঠানের নাম লিখতে পারেন।

তবে যেসব এলাকায় ভ্রাম্যমাণ এলাকার পা পড়েনি, সেখানে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। গুলশান ২ নম্বরের ৪৬ নম্বর সড়কে অবস্থিত ডিএনসিসি নগর ভবনের আশপাশের অনেক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড এখনো ইংরেজিতে লেখা। গোলচত্বরের চারপাশের ইউনিটেক, ডাটা ফটোকপি সেন্টার, গিয়ার এজ, গুরমিট বাজার, লাইটিং প্যালেস নামগুলো ইংরেজি হরফেই লেখা।

এই অভিজাত এলাকা থেকে দূরে সাতমসজিদ রোডে একটি নতুন বহুতল ভবনের বাইরের অংশে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টানানো। অধিকাংশই রেস্তোরাঁ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। এমনকি ভবনটির নামফলকও বড় ইংরেজি হরফে লেখা। তবে একটি প্রতিষ্ঠান ইংরেজিতে লেখা বিশাল সাইনবোর্ডের পাশে ছোট করে পৃথক ব্যানারে বাংলায় প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে টানিয়েছে।

এই ভবনের ২০০ গজের মধ্যে আরেক ভবনে আছে আটটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও ইংরেজিতে লেখা। জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সদ্য নির্মিত একটি ভবনে চালু হয়েছে সাত-আটটি রেস্তোরাঁ। ভবনের বাইরে টানানো প্রতিটি রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ড ইংরেজিতে।

আদালতের নির্দেশ ও সরকারি সিদ্ধান্ত
২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, দপ্তরের নামফলক বাংলায় লেখার নির্দেশ দেন আদালত। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আদালত স্থানীয় সরকার বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।

পরে ২০১৪ সালের ২৯ মে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মাধ্যমে এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কাগজে-কলমেই আটকে আছে সে সিদ্ধান্ত।

উদাসীন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন
ইংরেজিতে সাইনবোর্ড টানানো অন্তত ১৫টি প্রতিষ্ঠানের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই জানেন না বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা বাধ্যতামূলক। আবার অনেকে যুক্তি দেখান, ব্র্যান্ডের নাম ও লোগো ইংরেজিতে হওয়ার কারণে সাইনবোর্ড ইংরেজিতে বানানো হয়েছে।

ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় সাইনবোর্ড বাংলায় লেখার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। তারপরও অনেকে সেটা অনুসরণ করে না। সেসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের ক্ষমতা সিটি করপোরেশনের রয়েছে। অথচ সিটি করপোরেশন কখনোই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি।

অবশ্য ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এবার কিছুটা টনক নড়েছে। গত ২৮ জানুয়ারি ডিএনসিসি একাধিক সংবাদপত্রে একটি গণবিজ্ঞপ্তি দেয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরের সাত দিনের মধ্যে অন্য ভাষায় লেখা নামফলক, সাইনবোর্ড, ব্যানার বাংলায় প্রতিস্থাপনের অনুরোধ জানানো হয়। এর ব্যত্যয় হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি সাইনবোর্ড বাংলায় না লেখায় ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত গুলশান এলাকার ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। একই অভিযোগে ১৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুর রোডের আসাদগেট এলাকার সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

তবে ডিএনসিসির এ উদ্যোগের সঙ্গে ভাষার মাসের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করলেন ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাইনবোর্ড, ব্যানারে ভিনদেশি ভাষার ব্যবহার দীর্ঘদিনের অনভ্যাস। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগের ফলে জনগণের মধ্যে আইন মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এটি অব্যাহত থাকবে।

ডিএনসিসির পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি) বাংলায় সাইনবোর্ড প্রতিস্থাপনের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ডিএসসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদার প্রথম আলোকে বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পাশাপাশি সাইনবোর্ড ও ব্যানার বাংলায় লেখার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। ইরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড বা নামফলক নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অপসারণ না করলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা সমাজের সর্বস্তরে। কেউ উচ্চ আদালতের নির্দেশও মানছে না। শিক্ষা, জীবিকার ভাষা হিসেবে ইংরেজি প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলা পিছিয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, এ অবস্থা বদলাতে হলে শিক্ষিত শ্রেণি এবং সরকারকে আন্তরিকভাবে বাংলা চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে।