বরকতের রক্তে ভিজে যায় মুর্তজা বশীরের শার্ট

মুর্তজা বশীরের স্কেচে গুলিবিদ্ধ ভাষাশহীদ,  ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে প্রকাশিত
মুর্তজা বশীরের স্কেচে গুলিবিদ্ধ ভাষাশহীদ, ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’তে প্রকাশিত

ভাষা আন্দোলনে শহীদ বরকতের মৃত্যুর ঘটনা যাঁরা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁদের একজন শিল্পী মুর্তজা বশীর। আহত গুলিবিদ্ধ বরকতকে ধরাধরি করে যাঁরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই শিল্পীও ছিলেন। শুধু তা–ই নয়, বরকতের রক্তে মুর্তজা বশীরের শার্ট মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল। তিনি তখন আর্ট কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।

১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশে ফেব্রুয়ারি নামের ভাষা আন্দোলনের প্রথম যে সংকলন বের হয়, তাতে পাঁচটি স্কেচ এঁকেছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা তাঁর মনে কী গভীর রেখাপাত করেছিল, স্কেচগুলো দেখলেই বোঝা যায়। একটি স্কেচে দেখা যায়, আহত এক মিছিলকারী ঢলে পড়েছেন আরেক যুবকের কোলে। এটি আসলে একটি লিনোকাট। ছবিটি মুর্তজা বশীরের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া।

পরবর্তীকালে আমার জীবন ও অন্যান্য নামে একটি বইয়ে ‘একুশের চেতনা’ শিরোনামের একটি স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধে মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটির ঘটনা স্মরণ করেছেন। ওই দিন একটি প্রদর্শনী উপলক্ষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়েছিলেন। বেলা তিনটার দিকে তিনি মেডিকেল ব্যারাকে বসে ছিলেন। মুর্তজা বশীর লিখেছেন, ‘আমি আর হাসান বসে গল্প করছি। হঠাৎ আমি দেখলাম, মেডিকেল কলেজ ও ব্যারাকের মাঝখানটাতে পিঁপড়ে যেমন শস্যদানাকে ঘিরে নিয়ে আসে, সে রকম পাঁচ-ছয়জনের একটা জটলার মতো, তারা কী যেন নিয়ে আসছে। আমার কৌতূহল হলো, আমি দৌড়ে ওখানে গেলাম। আমিও ওই দলে ঢুকে গেলাম। দেখলাম, প্যান্টের মধ্যে শার্ট গোঁজা, লম্বা শেভ করা একজনকে। তার সারা মুখে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘামের বিন্দু। আর কল খুলে দিলে যেমন অঝোরে পানি পড়ে, তেমনি রক্ত ঝরছে। সে বারবার জিব বের করছে আর বলছে, পানি পানি। আমার হাতের রুমালটা ঘামে পানিতে ভেজানো ছিল। আমি ইতস্তত করছিলাম রুমালটা নিংড়ে দেব কি না। সে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিল। অবশেষে আমি নিংড়ে দিলাম। সে ফিসফিস করে বলল, “আমার নাম আবুল বরকত, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পল্টন লাইন, আমার বাড়িতে খবর দিয়েন।” আর কিছু বলেনি। বডিটাকে আমরা যখন মেডিকেলে নিয়ে গেলাম, সেখানে টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জে আহত আরও অনেকে এসেছে। প্রথম গুলিবিদ্ধ কাউকে আমরাই নিয়ে গিয়েছিলাম। নার্স, ডাক্তার সবাই ভয়ে বিহ্বল হয়ে গেল।…

‘আমি বেরিয়ে আসছি, দেখলাম, স্ট্রেচারের মধ্যে একটা লাশ। তার মাথার খুলিটা নেই। মগজটা বোধ হয় শুকনো দূর্বাঘাসে পড়ে ছিল, তার মধ্যে ঘাস লেগে রয়েছে। ওটাকে তুলে আবার ওই স্ট্রেচারের মধ্যে রাখা হয়েছে। পরে জেনেছি তার নাম ছিল রফিক।’

লিনোকাটের এই দৃশ্য অমর হয়ে আছে এই জন্য যে ঐতিহাসিক একটি মুহূর্তে একজন শিল্পীর নিজের উপস্থিত থাকা এবং সেই জ্বলজ্বলে স্মৃতি থেকে আঁকার ঘটনা বিরল। মুর্তজা বশীর আরেক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার আমি প্রত্যক্ষ সাক্ষী, সে জন্য আমি গৌরবান্বিত।’

গতকাল রাতে জানতে চাওয়া হলে মুর্তজা বশীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্কেচের যুবকটি সুনির্দিষ্টভাবে বরকত নয়। তবে ওই দিন নিজের অভিজ্ঞতার ছায়াপাত তাতে ঘটেছে।’