দখলদারদের উৎপাতে নদীর মরণদশা

>
কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়ায় বাঁকখালী নদীর সীমানার ভেতরে প্লট বানিয়ে চলছে আবাসন ব্যবসা। ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে (বাঁয়ে ওপরের দিকে নদীতে নোঙর করে রাখা নৌকা)।  ছবি: প্রথম আলো
কক্সবাজার শহরের পেশকারপাড়ায় বাঁকখালী নদীর সীমানার ভেতরে প্লট বানিয়ে চলছে আবাসন ব্যবসা। ১৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে (বাঁয়ে ওপরের দিকে নদীতে নোঙর করে রাখা নৌকা)। ছবি: প্রথম আলো

• বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড় থেকে বাঁকখালী নদীর উৎপত্তি।
• কক্সবাজার শহরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে নদীটি।
• নদীর জায়গায় প্লট বানিয়ে আবাসন ব্যবসা, চিংড়িঘের, কারখানা।
• উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরও নদীর সীমানা চিহ্নিত করা হয়নি।
• গত এক বছরে তালিকার বাইরে নতুন নতুন দখলদার যুক্ত হয়েছে।

কক্সবাজার শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাঁকখালী নদী দখল করে কেউ করেছেন আবাসন ব্যবসা, কেউবা বানিয়েছেন চিংড়িঘের। নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে লবণের কারখানা, মাছের আড়ত, করাতকল, শুঁটকিমহাল, বরফকলসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষ দখলদারদের তালিকা করে। সে তালিকায় ৭৩ জনের নাম রয়েছে। তবে তালিকা হলেও গত এক বছরে দখলদারদের উচ্ছেদে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দখলদারদের এই তালিকা অবশ্য স্থানীয় প্রশাসন নিজ উদ্যোগে করেনি। বাঁকখালী নদী বাঁচাতে এবং নদীর দখলদারদের উচ্ছেদে ২০১৪ সালে উচ্চ আদালতে একটি রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। রিটটি আমলে নিয়ে উচ্চ আদালত এই নদীর সীমানা নির্ধারণ এবং দখলদারদের তালিকা করতে নির্দেশ দেন। তালিকা হলেও এখন পর্যন্ত নদীর সীমানা চিহ্নিত করার কাজ শেষ হয়নি।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করেন দখলদারদের সঙ্গে প্রশাসনের যোগসাজশ রয়েছে। যে কারণে তারা উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে না। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন যে তালিকাটি করেছে, তা অসম্পূর্ণ। আদালতের নির্দেশ প্রতিপালিত না হওয়ায় বেলার পক্ষ থেকে শিগগিরই নতুন করে হাইকোর্টে আবেদন করা হবে।

তালিকা অনুযায়ী কেন দখলদারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে না জানতে চাইলে, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী আবদুর রহমান বলেন, তহবিল সংকটের কারণে উচ্ছেদ অভিযান চালানো যাচ্ছে না। ৭৩ দখলদারকে সরে যেতে বেশ কয়েকবার নোটিশ দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু নোটিশ পাওয়া অনেকে আবার উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন।

পরিবেশ কর্মীদের অভিযোগ, দখলদার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর বা পৌর কর্তৃপক্ষ কোনো সংস্থার গরজ নেই। উল্টো গত এক বছরে তালিকার বাইরে নতুন নতুন দখলদার যুক্ত হয়েছে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির পাহাড় থেকে বাঁকখালী নদীর উৎপত্তি। সেখান থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে এই নদী। ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর প্রস্থ একেক অংশে একেক রকমের। কক্সবাজার শহরে নদীর শুরু নুনিয়াছটা এলাকা থেকে, শেষ হয়েছে মাঝিরঘাটে। শহরের মধ্যে নদীর অংশ সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার। দখলদারদের উৎপাতও এখানেই বেশি।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ১০ বছর আগেও কক্সবাজার শহরের অংশে নদীর প্রস্থ ছিল ৫০০ মিটারের মতো। এখন তা গড়ে ৩৭ মিটার। নদীর বিভিন্ন অংশে ডুবোচর দেখা দিয়েছে। পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় নৌ-চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে ভাটার সময় বড় ট্রলার এখন আর বাঁকখালী নদীতে চলতে পারে না।

কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চঞ্চল দাশ গুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার শহরে নদীটির বিভিন্ন অংশ সরু খালে পরিণত হয়েছে। নদীর বর্তমান পাড় থেকে মাত্র ২০ মিটারের মধ্যেও স্থাপনা গড়ে তোলা হচ্ছে। নদীর এখন মরণদশা।

উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণের কাজ চলছে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব। তিনি বলেন, নদীর সীমানায় যাঁরা ভবন তৈরি করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা করা হবে।

সরেজমিনে ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুরে শহরের পেশকারপাড়ায় নদীর তীরে গিয়ে দেখা যায়, পাড় ভরাট করে ঘরবাড়ি তৈরির জন্য বিভিন্ন আকারের প্লট বানানোর কাজ চলছে। কোনো প্লট চার কাঠার আবার কোনোটি পাঁচ কাঠার। কয়েকটি প্লটে ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। শহরের বিভিন্ন পাহাড় থেকে মাটি এনে ভরাট হচ্ছে এসব প্লট। দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে একসময় নদী ছিল। প্লট ও স্থাপনা রক্ষায় দখলদারেরা নিজেদের টাকায় নদীর জোয়ারের পানি ঠেকাতে মাটি ফেলে বাঁধও নির্মাণ করেছেন। নদীর স্রোতধারার মাত্র ২০ মিটারের মধ্যে একটি ভবনের দেয়াল তোলা হচ্ছিল। সেখানে কথা হয় নির্মাণশ্রমিক মো. ইমনের (২৯) সঙ্গে। তিনি বলেন, ভবনটির মালিক শহরের হকার মার্কেটের ব্যবসায়ী জাকের হোসেন। এখানে সাততলা ভবন হবে। এখন আপাতত তিনতলা হবে। শ্রমিকেরা বলেন, জোয়ারের পানি থেকে ভবন বাঁচাতে ১০ ফুট মাটি ভরাট করা হয়েছে। মাটি আনা হয়েছে শহরের বিভিন্ন সরকারি পাহাড় থেকে। প্রতি ডাম্পার (মিনি ট্রাক) মাটি কিনতে হয়েছে দুই হাজার টাকা করে।

ভবনের মালিক জাকের হোসেন বলেন, দুই বছর আগে তিনি শহরের মোহাজেরপাড়ার এক ব্যক্তির কাছ থেকে এখানে চার শতক জমি কিনেছেন। এখন ভবন নির্মাণ করছেন। তবে ভবন নির্মাণের জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) থেকে অনুমতি নেননি তিনি। ভবনের নকশাও নেই।

এই ভবনের পাশে আরেকটি প্লটে ভবন নির্মাণ করছেন শহরের এন্ডারসন সড়কের ব্যবসায়ী সিরাজুল হক। ভবনটির দুইতলা ওঠে গেছে। ভবনের পশ্চিম ও উত্তর পাশে নদীর পাড় দখল করে তৈরি করা হয়েছে প্রায় ৫০টি আধাপাকা বাড়ি। এসব বাড়িতে ভাড়ায় থাকছেন বিভিন্ন পেশার শ্রমজীবী মানুষ।

নদীর সীমানায় ভবন নির্মাণের বিষয়ে সিরাজুল হক বলেন, অনেকের দেখাদেখি তিনিও ভবনটি তৈরি করেছেন। এ পর্যন্ত কেউ বাধা দেয়নি।

কক্সবাজার পৌরসভা কার্যালয় সূত্র জানায়, কস্তুরাঘাট, নূরপাড়া, পেশকারপাড়া, টেকপাড়া, নুনিয়াছটা, নতুন বাহারছড়া, মাঝিরঘাট এলাকায় গত কয়েক বছরে বাঁকখালী নদীর সীমানার প্রায় ৯৮ একর জমি দখল করে নানা অবকাঠামো তৈরি হয়েছে।

কক্সবাজার নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আব্দুর রহমান বলেন, শহরে যেকোনো অবকাঠামো নির্মাণের আগে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) ðঅনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু নদী দখল করে শত শত অবৈধ স্থাপনা তৈরি হলেও কেউ বাধা দিচ্ছে না।

এ বিষয়ে কউক চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ বলেন, বাঁকখালী নদীর বুকে কিংবা তীরে ভবন নির্মাণের জন্য কাউকে অনুমতি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারা এই ভবন নির্মাণ করেছেন-তা অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দখলদারদের থাবায় নদীর প্রস্থ কমে যাওয়ায় ঘাটের কাছে এখন আর খুব বেশি ট্রলার নোঙর করে রাখা যায় না বলে জানান কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও ঘূর্ণিঝড়ের সময় ৪ থেকে ৫ হাজার ট্রলার সাগর থেকে সরিয়ে নদীতে (কক্সবাজার শহর অংশে) নোঙর করা যেত। কিন্তু নদী প্রস্থে কমে যাওয়ায় এবং পানির গভীরতা কম থাকায় এখন এক হাজার ট্রলারও নোঙর করা যায় না।