দৃষ্টির বাধা জয় করা এক মর্জিনা

শৈশবে দৃষ্টিশক্তি হারান মর্জিনা আহমেদ। মনে হয়েছিল, জীবনটা বুঝি থেমেই গেল। কিন্তু দমে যাননি। দৃষ্টির বাধা জয় করে তিনি এখন দৃষ্টিজয়ী নারী।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ পদ্ধতি ব্রেইলের মাধ্যমে পড়াশোনা করেছেন মর্জিনা। প্রথমে ঢাকার মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট সংঘ অন্ধ বালিকা বিদ্যালয় স্কুল, পরে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন।

তবে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়তে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মর্জিনাকে। ব্রেইলে লেখা বই সহজে পাওয়া যেত না। ব্রেইলে লেখার জন্য ক্লাসে যথেষ্ট সময়ও পেতেন না। তখন থেকেই মর্জিনা ভাবতেন ব্রেইলের বই কীভাবে সহজলভ্য করা যায়।

ভাবনা আসার পরই কাজ শুরু। একটু একটু করে সবার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেন। ২০০৩ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন মর্জিনা। এরপর গড়ে তোলেন সংগঠন। নাম দেন ডিজেবেল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। শুরু করেন নিবন্ধনের কাজ। নিবন্ধনের জন্য পাশে পান হলের বন্ধুদের। নিবন্ধন তৈরি করা, জয়েন্ট স্টেন কোম্পানিতে আসা-যাওয়া, কাগজপত্র সংশোধন করাসহ আনুষঙ্গিক কাজে সময় লাগে তিন বছর। কাজ শেষ হয় ২০০৫ সালে।

ছোটাছুটির মধ্যেই ব্যারেল লেখা চালিয়ে যান মর্জিনা। সঙ্গে কেউ ছিল না। নিজেই ব্রেইল লিখতেন। নিজস্ব কোনো অফিস তখনো করে উঠতে পারেননি। তাই বাসায় বসেই লিখতেন। কাজ এগোচ্ছিল ধীরে ধীরে। এরপর ছোটখাটো একটা অফিস গড়ে তুললেন। কিনলেন পার্কিংস ব্যারেল মেশিন। শুরু হলো কাজ।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী নারী হিসেবে সব জায়গায় যাতায়াত মর্জিনার জন্য সহজ নয়। প্রয়োজনের সময় সাহায্য করার মতো সঙ্গীও পান না। তারপরও লড়াই চালিয়ে গেছেন। পেয়েছেন সাফল্য।

মর্জিনার অফিস ঢাকার মোহাম্মদপুরের শেখের টেক ৩ নম্বর সড়কে। বাড়ি নম্বর ৩৯। নিজের অফিসে দুজন সহকর্মীকে পাশে পেয়েছেন মর্জিনা। নিজেদের একটি স্কুলও করেছেন। সেখানে শিশুরা পড়াশোনা করে। প্রতিবন্ধী নয় এমন শিশুরাও পড়ে সেখানে। হাতে লেখা এবং পার্কিংস পদ্ধতির বদলে মর্জিনা এখন কম্পিউটারের মাধ্যমে ব্রেইল পদ্ধতিতে বই ছাপান। মর্জিনার প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারে লিখে ব্রেইল প্রিন্টারের মাধ্যমে বই ছাপানো হয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের মধ্যে বইগুলো বিতরণ করা হয়।

ব্রেইলে আরবি শিক্ষাও চালু করেছেন মর্জিনা। আরবি শিক্ষা নিয়ে সপ্তাহে দুই দিন ক্লাস হয়। এ ছাড়াও প্রতিবছর শিশুদের শিক্ষা উপকরণ ও উপবৃত্তি দেওয়া হয়। ঈদের সময় গরিব দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের পোলাওয়ের চাল, সেমাই, চিনি, দুধ, জামাকাপড় দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সহায়তা পেয়েছেন বলে জানালেন মর্জিনা। বলেন, এই প্রকল্পে ২০ জন ছেলে ও ১০ জন মেয়েকে শিক্ষা উপকরণ দিয়ে সাহায্য করেছেন।

মর্জিনা বলেন, চেষ্টা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। দৃষ্টির বাধা বা অন্য যে বাধাই আসুক না কেন দমে গেলে চলবে না। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

(লেখক: দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাংবাদিক)