অ্যাসিড-সন্ত্রাস মামলায় সাজা হাতে গোনা

>
  • ১৯ বছরে ১ হাজার ৯৩৪ নারী অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হলেও সাজা মাত্র ৩৩৪ জনের।
  • ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড এখনো কার্যকর হয়নি।

২০১২ সালের ১১ নভেম্বর রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার নবম শ্রেণির ছাত্রী ফারজানা আক্তারের মাথা, মুখমণ্ডল ও বুক অ্যাসিডে ঝলসে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২২ দিন মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।

সাড়ে চার বছর পর ২০১৭ সালের ৫ জুলাই এক আসামির মৃত্যুদণ্ড ও বাকি ছয় আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়ে রায় দেন আদালত। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ালেও কাগজপত্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ওই আসামিকে দেখানো হচ্ছে ‘পলাতক’।

ফারজানার বাবা জালাল উদ্দিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কার্যকর করা না হলে “মৃত্যদণ্ড” দিয়ে কী হবে? আমরা এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পেলাম না।’
ঝলসানো শরীর ও প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে বিচারের জন্য ঘুরছেন খুলনার নাছিমা আক্তার। সাক্ষীর অভাবে তাঁর মামলা খারিজ হয়ে গেছে। কান্নায় ভেঙে পড়ে নাছিমা সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামী মারা গেছে, সন্তান অসুস্থ। যা টাকাপয়সা ছিল, তা মামলার জন্য ব্যয় করেছি। কিন্তু বিলম্ব হওয়ায় সাক্ষীরা এখন আর আসতে চান না।’

অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ অনুযায়ী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ) সূত্র জানায়, গত ১৯ বছরে ১ হাজার ৯৩৪ নারী অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হলেও সাজা পেয়েছে মাত্র ৩৩৪ জন ব্যক্তি। তাঁদের মধ্যে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলায় ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও আজ পর্যন্ত কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। বরং ইতিমধ্যে ১ হাজার ৯০৮ জন আসামি খালাস পেয়ে গেছেন।

অ্যাসিড মামলা তদারক করার জন্য গঠিত জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের তিন মাস পরপর বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও গত দুই বছরে একটি সভাও হয়নি। আর জেলা কমিটির বৈঠক প্রতি দুই মাসে একবার হওয়ার কথা, কিন্তু তা-ও হচ্ছে না।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলায় এ পর্যন্ত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে ১২৪ জনকে। এ ছাড়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৮৪৬টি মামলার। শরীরের বিভিন্ন স্থানে অ্যাসিডের ক্ষত থাকলেও বেশির ভাগ মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে অ্যাসিড-সংক্রান্ত মামলায় বাদী ও স্বজনদের।

দুই বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এত অধিকসংখ্যক মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন (অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া) দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি পুলিশ অধিদপ্তরকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেন। কিন্তু সেই প্রতিবেদন আজও দেয়নি পুলিশ।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারি কৌঁসুলিকে অ্যাসিডে আক্রান্তদের মামলার ক্ষেত্রে আরও যত্নবান হতে বলেছি। এ ছাড়া পুলিশ যেন সঠিকভাবে তদন্ত করে, সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছি। তবে তাঁরা নানা ব্যাখ্যা দেন, আর বলেন সাক্ষী পাওয়া যায় না বলেই তাঁরা সঠিকভাবে তদন্ত করতে পারেন না।’

এএসএফের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার নারীদের ন্যায্য বিচার পাওয়ার বিষয়টিকে কেউই গুরুত্ব দিচ্ছে না। শুরুটাই হয় পুলিশের দুর্বল তদন্ত দিয়ে। এ ছাড়া আক্রান্ত নারী এবং সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে না পারায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার উল্টো আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারকে হুমকি দেয়। তিনি বলেন, অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলের কোনো দৃশ্যমান কাজ নেই। দুই বছরে একটি বৈঠক না করলে পুলিশ কার কাছে এসব বিষয়ে জবাবদিহি করবে?

অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের নিয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও নিয়মিত কাজ করছে এএসএফ ও প্রথম আলো ট্রাস্ট। ১৯৯৯ সাল থেকে অ্যাসিডদগ্ধ ব্যক্তিদের জন্য কাজ শুরু করে এএসএফ। ২০০০ সালে গঠিত হয় অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য প্রথম আলো সহায়ক তহবিল। এ তহবিল অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের দেশে-বিদেশে চিকিৎসাসেবা ও আইনি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাবৃত্তি, জমি, ঘরবাড়ি, দোকান-ভ্যান, গাভি প্রদানসহ নানাভাবে পুনর্বাসনে সাহায্য করেছে। একই সঙ্গে প্রথম আলো নারীর ওপর অ্যাসিড-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।