দায় নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য

>

• নেপালে এটিসির ছয় কর্মী প্রত্যাহার।
• কথোপকথন ফাঁসের তদন্ত।
• ইউএস-বাংলার অভিযোগ অস্বীকার নেপালের।
• এয়ারক্রাফটি উড্ডয়নের উপযোগী ছিল।

পাইলটের কোনো দোষ ছিল না, বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের (এটিসি) বিভ্রান্তিকর বার্তার কারণে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ। তবে ইউএস-বাংলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, পাইলট নির্দেশনার উল্টো দিক দিয়ে উড়োজাহাজটি নামাচ্ছিলেন। পাল্টাপাল্টি দোষারোপের এই বিষয়টি উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতেও।

পাইলটদের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের ফাঁস হওয়া কথোপকথনের রেকর্ড বিশ্লেষণ করে বেসামরিক বিমান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিভ্রান্তি একটা তৈরি হয়েছিল বটে; তবে তদন্ত শেষ হওয়ার পরেই আসল কারণ বোঝা যাবে। তাঁরা বিমানবন্দরের দুই প্রান্তের সাংকেতিক নাম জিরো টু (০২-দক্ষিণ প্রান্ত) এবং টু জিরোর (২০-উত্তর প্রান্ত) মধ্যে গুলিয়ে ফেলার শঙ্কাও করেছেন। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের বাজে নিরাপত্তাব্যবস্থাও আলোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে।

৭১ জন যাত্রী ও ক্রু বহনকারী ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি সোমবার নেপালে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয়।

ইউএস-বাংলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ ইমরান নেপালের এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে দায়ী করে বলেছেন, তারা ভুল বার্তা দিয়েছিল।

ইউএস-বাংলার জনসংযোগ বিভাগের প্রধান কামরুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, উড়োজাহাজের পাইলটের দোষ তাঁরা খুঁজে পাননি। একই মডেলের ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ মডেলের বিমান তিনি ১ হাজার ৭০০ ঘণ্টা পরিচালনা করেছেন। তিনি ৫ হাজার ঘণ্টার ওপরে বিভিন্ন উড়োজাহাজে কাজ করেছেন। কাঠমান্ডু বিমানবন্দরেই তিনি শতাধিকবার যাতায়াত করেছেন।

কামরুল বলেন, বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার ও পাইলটের শেষ সময়ের কথোপকথন গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে। ইউটিউবে রেকর্ড আছে। বিশ্ব গণমাধ্যম নেপালের নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারকে কিছুটা দোষারোপ করছে।

তবে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রী তাঁদের কোনো ত্রুটি ছিল না উল্লেখ করে সিএনএনকে বলেন, ‘নেপালের এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে তাঁদের ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছিল বলে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ যে বক্তব্য দিয়েছে, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করছি। উড়োজাহাজটিকে দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে নামার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি উত্তর প্রান্ত দিয়ে নামে।’

রাজ কুমার বলেন, ‘আমাদের বিমানবন্দরের কর্মীরা আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমরা পাইলটদের সঙ্গে বারবারই যোগাযোগ করে তাঁদের সঠিক দিক দিয়ে নামতে বলেছিলাম।’

সিএনএনকে নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (সিএএন) মহাপরিচালক সঞ্জীব গৌতম বলেন, নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছিল, এটা একেবারেই ঠিক নয়। আবহাওয়া ছিল পরিষ্কার। পাইলটদের দৃষ্টিসীমা ছিল অন্তত পাঁচ কিলোমিটার। পাইলটরা নিশ্চিত করেছিলেন যে তাঁরা রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন। আমাদের কাছে এর প্রমাণও রয়েছে যে তাঁরা রানওয়ে দেখার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন।’

সঞ্জীব বলেন, ‘পাইলটরা আমাদের নির্দেশনা অনুসরণ করছিলেন না। অবতরণের সময় উড়োজাহাজটিকে নিয়ন্ত্রণহীন দেখা গেছে। এর মাপজোখ ঠিক ছিল না, এটা একদিকে কাত হয়ে ছিল। ক্রুদের অস্বাভাবিক আচরণ প্রত্যক্ষ করার পর সব উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ও অবতরণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।’

বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরে ত্রুটিপূর্ণ যোগাযোগ উড়োজাহাজটি বিধ্বস্তের জন্য দায়ী কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিবিসি। সংস্থাটি বলছে, বিধ্বস্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো পরিষ্কার নয়, তদন্ত শুরু হয়েছে। তবু রেকর্ডিং শুনে মনে হয়, একমাত্র রানওয়েটির কোন প্রান্ত দিয়ে উড়োজাহাজটি অবতরণ করবে, সেটি নিয়ে একটা ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে।

ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের পাইলট ক্যাপ্টেন পবনদ্বীপ সিং বিবিসিকে বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই এ ক্ষেত্রে কী হয়েছিল, তবে এটা মনে হয় যে পাইলট যখন প্লেনটি অবতরণের চেষ্টায় ছিলেন, তখন যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটা বিভ্রান্তি ছিল। কিন্তু আমরা পুরো সত্যটি তখনই জানতে পারব যখন তদন্তকারীরা প্রতিবেদন জমা দেবেন।’

পবনদ্বীপ সিং আরও বলেন, এটা মনে হচ্ছিল পাইলট ‘ভিজ্যুয়াল ল্যান্ডিংয়ের’ চেষ্টা করছিলেন। সাধারণত উড়োজাহাজ অবতরণের ক্ষেত্রে পাইলটরা ইনস্ট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম (আইএলএস) ব্যবহার করেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে যখন রানওয়ে পাইলটের দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকে, তখন ভিজ্যুয়াল ল্যান্ডিংও (ম্যানুয়ালি) অনুমোদিত। কিন্তু কাঠমান্ডুর মতো বিমানবন্দরে ভিজ্যুয়াল অবতরণ খুবই ঝামেলাপূর্ণ।

বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ গ্রেগ ওয়ালড্রন বিবিসিকে বলেন, আগের ক্রাশগুলোর একটা কারণ বিভ্রান্তিকর যোগাযোগ। এই বিভ্রান্তিকর যোগাযোগ ভূমি থেকে উড়োজাহাজের মধ্যে এবং ককপিটের ক্রুদের মধ্যেও হতে পারে। যদিও উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটদের কথোপকথনের রেকর্ডিং থেকে মনে হয় যে ক্রুরা সম্ভবত অসংলগ্ন ও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিলেন।

তবে ভারতীয় বৈমানিক পবনদ্বীপ সিংয়ের মতে, ছড়িয়ে পড়া কথোপকথনে যে ভাষার ব্যবহার হয়েছে, তা বিশ্বব্যাপী মানসম্মত। তিনি বলেন, ‘আমরা কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে খুব কমই সমস্যার মুখোমুখি হই এবং পাইলটরা সব সময় নির্দেশনাগুলো রিপিট করেন, যাতে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ না থাকে। কেবল সংখ্যার ক্ষেত্রে ভুল-বোঝাবুঝি হতে পারে। এ ঘটনার ক্ষেত্রে জিরো টু (০২) এবং টু জিরো (২০) সংখ্যা দুটো নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল বলে মনে হয়।’

ঝামেলাপূর্ণ ত্রিভুবন

পবনদ্বীপ সিং বলেন, আরেকটা বিষয় হতে পারে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরটির অবস্থান। কাঠমান্ডু পৃথিবীর সহজতম বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে নেই। সেখানে পর্বতের ফাঁক দিয়ে যেতে হয়। তিনি বলেন, ‘নেপালে উড়োজাহাজ চালাতে পাইলটদের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। আমি সেখানে উড়োজাহাজ চালিয়েছি এবং আমি বলতে পারি, এটা ব্যস্ততম একটি বিমানবন্দর।’

কাঠমান্ডুতে অবতরণ করা কেন কঠিন, সেটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এয়ার ইন্ডিয়ার জ্যেষ্ঠ কমান্ডার বেসিল মোসেস। বিবিসিকে তিনি বলেন, দুই পাশে পর্বতের ফাঁক গলে বিমানবন্দরে ঢোকা ও বের হওয়া সব পাইলটের জন্যই ঝামেলাপূর্ণ। রাতের বেলায় এবং ঝড়-বৃষ্টির সময় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। তবে বলা হচ্ছে, ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটি যখন সেখানে এসেছিল, তখন আবহাওয়া ভালো ছিল।

ছয় কর্মী প্রত্যাহার, কথোপকথন ফাঁসের তদন্ত

নেপালের গণমাধ্যম মাই রিপাবলিকা বলছে, নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (সিআইবি) যৌথভাবে ফাঁস হওয়া কথোপকথনটির বিষয়ে তদন্ত করবে। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সঞ্জীব গৌতম বলেন, আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) বিধান অনুযায়ী, ব্ল্যাকবক্সের তথ্য, পাইলট ও নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের কথোপকথন এবং ফ্লাইটের তথ্য প্রকাশ করা নিষিদ্ধ। ফাঁস হওয়া এই কথোপকথনের বিষয়ে তদন্ত করা হবে।

গৌতম আরও বলেন, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষে (এটিসি) কর্মরত ছয়জনকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

এয়ারক্রাফটি উড্ডয়নের উপযোগী ছিল

ইউএস–বাংলা ড্যাশ মডেলের এয়ারক্রাফটটি ঢাকা ছাড়ার আগে ওড়ার সম্পূর্ণ উপযোগী ছিল। সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশের (সিএএবি) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান গতকাল ঢাকায় এ কথা বলেন।

সিএএবি সদর দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘এয়ারক্রাফটটি ওড়ার আগে নিরাপত্তার সব প্রক্রিয়া আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত এয়ারক্রাফটটির ব্ল্যাকবক্স নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান কানাডার বোমবারডিয়ারে পাঠানো হবে। ব্ল্যাকবক্স ডিকোডিংয়ের পরে আমরা বলতে পারব, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল, নাকি মানুষের ভুল ছিল।’