দখল, দূষণে মরে যাচ্ছে ময়ূর নদ

কচুরিপানায় আর আবর্জনায় ভরা ময়ূর নদ। গতকাল খুলনার গল্লামারী এলাকায়।  প্রথম আলো
কচুরিপানায় আর আবর্জনায় ভরা ময়ূর নদ। গতকাল খুলনার গল্লামারী এলাকায়। প্রথম আলো

• আজ আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস।
• ময়ূর খুলনা নগরের কোল ঘেঁষে এক নদ।
• নদটি নগরের হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত।
• এখন পেখম ছাঁটা ময়ূরের মতোই অবস্থা এই নদের।

একটা সময় দাপটের সঙ্গে চলত ময়ূর। এখন যেমন শ্রী হারিয়েছে, তেমনি হারিয়েছে গতি। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। মৃতপ্রায় দেহটা আবার চাপা পড়ছে ময়লা-আবর্জনায়।

এই ময়ূর আসলে পাখি নয়; খুলনা নগরের কোল ঘেঁষে এক নদ। নগরের হৃৎপিণ্ড হিসেবে পরিচিত। তবে এখন পেখম ছাঁটা ময়ূরের মতোই অবস্থা তার। দখলে প্রতিনিয়ত আয়তন সংকুচিত হচ্ছে। দূষণে পানির চেহারা কুচকুচে কালো। দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়া দায়। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার মতো দ্রবীভূত অক্সিজেন (ডিও) নেই। একসময়ের খরস্রোতা নদটি এখন এক মরা খাল।

গঙ্গা অববাহিকার পুরোনো নদ ময়ূর ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ। খুলনা নগরের পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। আগে রূপসা নদীর সঙ্গে ময়ূরের সরাসরি সংযোগ ছিল। এখন জলকপাটের (স্লুইসগেট) মাধ্যমে জোয়ার-ভাটা নিয়ন্ত্রিত। স্লুইসগেট বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে। ফলে পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, ‘ময়ূর নদের ৫০-৬০ শতাংশ নগরের মধ্য দিয়ে গেছে। নদীটি অনেক আগেই নাব্যতা হারিয়েছে। বর্তমানে অবস্থা খুবই নাজুক। নদের পাড়ে দখলদারদের দৌরাত্ম্য চলছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পানিদূষণ হচ্ছে। পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে একে রক্ষার জন্য প্রশাসনকে তাগিদ দিয়েছি।’

কোথাও বেড়া দিয়ে,কোথাও মাটির বাঁধ দিয়ে নদের জায়গা দখল করা হয়েছে। আবার নদের পাড়ের অনেক মানুষ একটু একটু করে নদী ভরাট করে জায়গা বাড়িয়ে নিচ্ছে।

নদের পাড়ের বাসিন্দা মনু মিস্ত্রি আক্ষেপ করে বলেন, দুই যুগ আগেও এই নদী দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে নৌকা চলাচল করত। পানি ছিল পরিষ্কার। এখন পচা ডোবা হয়ে গেছে। নৌকা তো চলেই না। নদের পানি এখন শৌচকার্যেও ব্যবহার করা যায় না।

ময়ূরের মৃত্যুঘণ্টা বাজানোর আরেক বড় কারণ নগরের নালা-নর্দমা। খুলনা নগরের পানিনিষ্কাশন হয়ে থাকে পাশের বিভিন্ন নদীতে। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ২০টির বেশি নালার মুখ ময়ূর নদের সঙ্গে মিলিত। এসব নালা-নর্দমার ময়লা-আবর্জনা বিষাক্ত করে তুলছে নদের পানি।

খুলনা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শহরের ২০টির বেশি নালা থেকে বর্জ্যমিশ্রিত পানি ময়ূর নদে পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এগুলো যাতে পরিশোধন করে নদীতে ফেলা যায়, সে জন্য একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, গল্লামারী এলাকায় সেতুর নিচে রাশি রাশি বর্জ্য। বেশ কয়েকটি মরা মুরগি ভাসছে। দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। গল্লামারী বাজারের ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে স্থানটি। নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বহু পাকা স্থাপনা। নর্দমার আবর্জনা এসে পড়ছে নদে। যত দূর চোখ যায় কালো পানি। তার বুকে শুধুই কচুরিপানা। নদের পাড়ে লিনিয়ার পার্ক এলাকায় কচুরিপানা কম। তবে পাড়ে জন্মানো আগাছা একেবারে মাঝনদীতে চলে গেছে।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ময়ূর নদের পানির মান উন্নয়নে একটি সুপারিশ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনা কার্যালয়। কার্যালয়ের তৎকালীন পরিচালক অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠান। তাতে উল্লেখ করা হয়, ময়ূর নদের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) মান নিচে নেমে যাওয়ার পেছনে অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দায়ী। এই বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডিওর মানোন্নয়ন করা যেতে পারে। চিঠিতে আরও বলা হয়, জনসংখ্যার আধিক্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিষয়ে অসচেতনতাসহ নানা কারণে ঐতিহ্যবাহী নদটি শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের মতো দূষণের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

সেই অবস্থার এখনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয় প্রতি মাসে ময়ূর নদের গল্লামারী সেতুর তিনটি পয়েন্টে পানির দূষণমাত্রা পরীক্ষা করে। গত জানুয়ারি মাসে দেখা যায়, নদের পানিতে ডিও ছিল ১ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম/লিটার। ফেব্রুয়ারি মাসে ছিল ১ দশমিক ৫ মিলিগ্রাম/লিটার। অথচ জলজ প্রাণীর জীবনধারণের জন্য পানিতে প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি ডিও থাকা প্রয়োজন।

পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ মো. কামরুজ্জামান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এই নদের পানিতে ডিওর মান সারা বছরই গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কম থাকে। ডিও এই মানে প্রতীয়মান হয়, ময়ূর নদের পানি খুবই দূষিত। এই পানি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, পানিতে ডিওর মাত্রা প্রতি লিটারে ৬ মিলিগ্রামের নিচে নেমে গেলে ছোট মাছ বাঁচে না। ময়ূর নদে বছরের বেশির ভাগ সময়ই ডিও শূন্যের কোঠায় থাকে।

ময়ূরকে বাঁচাতে অন্তত সাতটি কাজ করতে হবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। অন্তত ৫০ ফুট পরপর নদের সীমানা নির্ধারণী খুঁটি স্থাপন করতে হবে, দখলদারদের তালিকা তৈরি ও উচ্ছেদ করতে হবে, আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে, দূষণের উৎসমুখ চিহ্নিত করতে হবে, পয়োবর্জ্য এবং কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করতে হবে, খুলনা নগরের বিভিন্ন ড্রেনের বর্জ্য এই নদে ফেলার আগে অবশ্যই পরিশোধন করে নিতে হবে এবং নদে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রাণ ওষ্ঠাগত ময়ূরকে রক্ষায় অতীতে নানা পদক্ষেপের কথা শোনা গেছে। তবে বাস্তবে এই নদকে বাঁচানো যাবে, এমন কোনো উদ্যোগ নেই। কয়েক বছর আগে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে ময়ূর নদ খনন করা হয়। নগরের জলাবদ্ধতা নিরসন ছিল এই খননকাজের লক্ষ্য। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এককভাবে কোনো সংস্থা ময়ূর নদকে রক্ষায় সফল হবে না। নদটা নিয়ে শুধু আবেগের কথা হচ্ছে; সমন্বিত কাজটা হচ্ছে না। কাজের কাজ হচ্ছে না। তিনি বলেন, নদী রক্ষা কমিশন যদি ভূমি মন্ত্রণালয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দিষ্টভাবে কাজ ভাগ করে দেয় এবং কাজের সমন্বয় করে, তাহলে ভালো ফল আসতে পারে। প্রাণ ফিরে পেতে পারে নদটি।