রাখাইনে আন্তর্জাতিক অপরাধ হয়েছে

ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁরা। সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে।  ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁরা। সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

জাতিসংঘ মহাসচিবের গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক বিশেষ উপদেষ্টা আদামা দিয়েং মনে করেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নৃশংসতার ব্যাপারে বছরের পর বছর আগাম সতর্কবার্তা থাকার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বালিতে মুখ গুঁজে ছিল। এ জন্য রোহিঙ্গাদের জীবনের মূল্য দিতে হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নৃশংসভাবে হত্যা, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, ধর্ষণসহ নানা রকম সহিংসতায় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধে’র সব ধরনের আলামতই আছে। ওই নৃশংসতা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ নাকি ‘গণহত্যা’ (জেনোসাইড), সেটি এ-সংক্রান্ত আদালতই ঠিক করবেন।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন আদামা দিয়েং। তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার দায়ে মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীকে বিচারের আওতায় আনতে নিরাপত্তা পরিষদ, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এবং আঞ্চলিক প্রভাবশালী শক্তিকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
দিয়েং বলেন, ‘রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নৃশংসতা মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ যেভাবে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে, তা আমাকে হতবুদ্ধি করে দেয়। কাজেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এটা প্রমাণের সময় এসেছে, তারা এ ধরনের বর্বরতা আর দেখতে চায় না।’
রুয়ান্ডায় গণহত্যার বিষয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক এই রেজিস্ট্রার মনে করেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা পরিচালনাকারীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নিতে হলে বিশ্বসম্প্রদায়ের জোরালো এবং সমন্বিত চেষ্টা থাকা উচিত। অর্থাৎ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা ভেটো না দিলেও এটা সম্ভব।
দিয়েং বলেন, ‘মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের তাদের পরিচয়ের কারণে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা এবং হেনস্তা করা হয়েছে। যেসব তথ্য আমি পেয়েছি তা থেকে এটা স্পষ্ট যে উত্তর রাখাইন থেকে তাদের পরিচয় মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে এটা করা হয়েছে—এটা প্রমাণিত হলেই গণহত্যার অপরাধের ভিত্তি তৈরি হয়।’
দিয়েং অবিলম্বে রাখাইনে নৃশংসতা বন্ধের জন্য বিশ্বসম্প্রদায়সহ চীন, ভারত ও আসিয়ানকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। দিয়েং বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবেই আশা করব, এ অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে চীন তার ভূমিকা পালন করবে। এটা খুব জরুরি। মানবতার প্রশ্নে এবং জীবন বাঁচানোর স্বার্থেই এটা গুরুত্বপূর্ণ। চীনের পাশাপাশি ভারতও তার প্রভাবকে কাজে লাগাবে। চীন ও ভারত তাদের নৈতিক নেতৃত্বকে কাজে লাগাবে। শুধু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্য না হলেও যেকোনো দেশকে বিচারের আওতায় আনা যায়, এ প্রসঙ্গে তিনি সুদান ও লিবিয়াকে আদালতে নেওয়া হয়েছিল বলে জানান। আফ্রিকার দেশ চাদের সাবেক স্বৈরশাসক হিন নে হাবরকে আঞ্চলিক আদালতে বিচার করা হয়েছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আসিয়ানের দেশগুলোতে বিশেষ আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি তিনটি প্রস্তাব দেন। তাঁর মতে, রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণের সুরাহা করতে হবে। একমাত্র এটি হলেই রোহিঙ্গারা নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরতে পারবে। কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে অবস্থানের সময় তাদের সব ধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে কক্সবাজারে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ যেভাবে আশ্রয় দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তার জন্য তিনি বাংলাদেশের প্রতি আরও সমর্থন জানাতে বলেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে।
এক প্রশ্নের উত্তরে দিয়েং জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার এখন পর্যন্ত কোনো সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেনি।

সংখ্যালঘু নেতাদের সঙ্গে
আদামা দিয়েং গতকাল দুপুরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কার্যালয়ে গিয়ে পরিষদ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা ও তাদের অধিকারহীনতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করেই গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর আগে বক্তব্য দেন ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।