'আমি সব সময় দৌড়ের ওপর থাকি'

সখীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে কাজ করছেন অডিটর আজিজুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো
সখীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে কাজ করছেন অডিটর আজিজুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের নিরীক্ষক (অডিটর) আজিজুর রহমান। সাত পদের এই কার্যালয়ে সাড়ে তিন মাস ধরে তিনি একাই কাজ করছেন। একজন পিয়ন, টাইপিস্ট একজন, তিনজন জুনিয়র অডিটর, উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ও একজন অডিটরসহ সাত পদে সাতজন কর্মী থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে সেখানে অডিটর পদে বর্তমানে আজিজুর রহমান একাই কর্মরত রয়েছেন।

বাকি পদ শূন্য থাকায় নানা সংকটে জর্জরিত কার্যালয়টি। এতে সময়মতো মাসিক বেতন পেতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন উপজেলার সরকারি কার্যালয়ের কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রতিটি উপজেলার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজের শিক্ষকেরা তাঁদের বেতন-ভাতা পান উপজেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে। সখীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে সাতটি পদ রয়েছে। গত চার বছর ধরে এই কার্যালয়ের পিয়ন নেই। দুই বছর ধরে জুনিয়র অডিট কর্মকর্তার তিনটি পদ শূন্য। টাইপিস্ট নেই নয় মাস ধরে। গত ৪ জানুয়ারি উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. শাহজামাল বদলি হয়ে চলে যাওয়ায় গত সাড়ে তিন মাস ধরে নিরীক্ষক কর্মকর্তা আজিজুর রহমান একাই সাতজনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সারা দিন অফিস করে বিকেলে ব্যাগে করে কাগজপত্র নিয়ে বাসাইল উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সই নিতে যান আজিজুর রহমান। কাজ শেষ করে রাতে বাড়ি ফেরেন তিনি।

আজিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুরি হওয়ার ভয়ে রাতের বেলায় ব্যাগ বুকের মধ্যে আগলে রেখে ঘুমাই। সকালে আবার ওই সই করা কাগজপত্র কার্যালয়ে নিয়ে আসি। আমার অসুখ-বিসুখ অথবা কোনো অসুবিধা হলে অফিস তালা থাকবে আর কেউ বেতন তুলতে পারবেন না। তাই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু কষ্ট হলেও নিয়মিত অফিস করি।’

প্রতিদিন উনিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি থেকে অফিস করতে হয় নিরীক্ষক আজিজুর রহমানকে। অফিসে পিয়ন যেহেতু নেই, তাই অফিস পৌঁছেই প্রথমে তাকে তিনটি কক্ষের তালা খুলে ঝাড়ু দিতে হয়। এরপর কম্পিউটারে বসে সরকারি ও অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতার কাগজপত্র প্রস্তুতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে অফিসে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। সব ভিড় তাঁকে একাই সামাল দিতে হয়।

আজিজুর রহমান বলেন, ‘দুপুর বেলা খেয়ে আবার কাজে বসে পড়ি। বেলা চারটা বাজার পর সব কাগজপত্র ব্যাগে ভরে হেঁটে স্টেশনে যাই। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে পাশের উপজেলা বাসাইলের কার্যালয়ে পৌঁছাই। বাসাইল উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল আজিজ স্যারের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে সই নিতে রাত আটটা বেজে যায়। এরপর ১০-১২ কিলোমিটার দূরে আমার গ্রামের বাড়ি বাসাইলের কাঞ্চনপুর আসি। রাতের খাবার খেতে ১১টা বেজে যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি ১৯ কিলোমিটার পেরিয়ে আবার সখীপুর উপজেলায় গিয়ে অফিস করি। আমার অফিসের সাতজনের কাজ একাই করি। আমি সব সময় দৌড়ের ওপর থাকি।’

সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসের নানা টেলিফোনও তাকে রিসিভ করতে হয়। ৫৫ বছর বয়সে অফিসের এত চাপে হাঁপিয়ে উঠেছেন বলেও জানান তিনি।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সখীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, একজন মাত্র কর্মকর্তা আজিজুর রহমান ফোনে কথা বলছেন আর কম্পিউটারে কাজ করছেন। তাঁর কক্ষে স্থানীয় হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ নার্স অঞ্জলা মল বসে আছেন। তিনি একটু ভুলের কারণে গত ১৫ দিন ধরে বেতন তুলতে পারছেন না। অঞ্জলা মল বলেন, ‘সাতজন কর্মকর্তা ওই কার্যালয়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে আমি মাসের ২-৩ তারিখেই বেতন নিতে পারতাম।’

ওই কার্যালয়ে বসে থাকতে দেখা যায় সখীপুর উপজেলা সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম খলিলকে। তিনি বলেন, ‘প্রতি মাসের এক তারিখে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সাধারণত বেতন তোলেন। কিন্তু কর্মকর্তা ও লোকবল না থাকায় আমরা ৭০০ শিক্ষক এক সপ্তাহ পরে বেতন নিয়েছি।’ কার্যালয়ে বসে থাকা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অফিসে কর্মকর্তা ও কর্মচারী না থাকায় প্রতি মাসে অবসরভাতা নিতে নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বুড়ো বয়সে এমন কষ্ট আর হয়রানি ভালো লাগে না।’

সখীপুর উপজেলা পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, ‘সখীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের নামে সাংসদের দেওয়া একটি ব্যাংক চেকে উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সই নিতে আমাকে কয়েক দিন ঘুরতে হয়েছে। পরে সখীপুর থেকে বাসাইল উপজেলায় গিয়ে কর্মকর্তার সই আনতে হয়েছে।’

সখীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা বাসাইল উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবদুল আজিজ খান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা বিভাগে ২৮টি উপজেলায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নেই। এ ছাড়া প্রতিটি কার্যালয়েও লোকবলের সমস্যা রয়েছে। আমি সপ্তাহে তিন দিন ওই কার্যালয়ে গেলেও সময় মতো বেতনাদি দেওয়া কষ্টসাধ্য। তাই প্রতিদিন সখীপুর কার্যালয়ের অডিটর বাসাইল এসে আমার সই নিয়ে যাওয়ায় চাকরিজীবীদের হয়রানি অনেকটা কমেছে।’