হাসপাতালে ঘরসংসার

• বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।
• কেউ কেউ কেবিন দখল করে আছেন দীর্ঘদিন ধরে।
• প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা রোগীদের ক্ষোভ।

হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডের এই কেবিনটি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ।  ছবি: প্রথম আলো
হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডের এই কেবিনটি দীর্ঘদিন ধরে তালাবদ্ধ। ছবি: প্রথম আলো

হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে ঘরকন্নার কাজে যা লাগে, তার প্রায় সবই আছে কক্ষটিতে। বাসিন্দারা বেশ জমিয়ে ঘরসংসার পেতে বসেছেন। আরেকটি কক্ষের ভেতরে দড়িতে ঝুলছে স্বামী-স্ত্রীর কাপড়। জানা গেল, তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এখানে আছেন। এখানে থাকা অবস্থায় প্রথম স্ত্রী মারা যান। তারপর তিনি নতুন বিয়ে করে বউ নিয়ে আছেন। বাসাবাড়ি না, এটি একটি হাসপাতালের চিত্র।

হাসপাতালের কেবিন দখলের এই চিত্র রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডের। দোতলা ভবনটিতে ১৬টি কেবিনসহ মোট ৪০টি শয্যা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু এসব কেবিনের অন্তত চারটি মুক্তিযোদ্ধারা রোগী সেজে দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

১৯৭২ সালে এই প্রতিষ্ঠানের দোতলা ভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি ওয়ার্ড চালু করা হয়। নিচতলায় সাধারণ ওয়ার্ড এবং দোতলায় কেবিন। এই হাসপাতালের ‘কমান্ডার’ লেখা একটি কেবিনের সন্ধান মিলল, যেখানে মাসের পর মাস রোগী নেই। কেবিনটিও তালাবদ্ধ। চাবি ও হাসপাতালের রোগীর ফাইল আছে কথিত এক রোগীর জিম্মায়।

হাসপাতালের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, ১৬টি কেবিনের মধ্যে ৪টি দখল হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আরেকটি কেবিন মুক্তিযোদ্ধারা ‘বিনোদনকক্ষ’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। ১ নম্বর ভিআইপি কেবিন দীর্ঘদিন দখল করে রেখেছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক গত মঙ্গলবার হাসপাতালটিতে গিয়েছিলেন। তারপর বৃহস্পতিবার ওই মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতাল থেকে ‘রিলিজ’ নিয়ে চলে গেছেন। অপর একটি কেবিন দখল করে রেখেছেন নতুন বিয়ে করা এক মুক্তিযোদ্ধা। তবে এই মুক্তিযোদ্ধা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তিনি ছয় মাস ধরে ভর্তি আছেন।

হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চলে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে গতকাল রোববার কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতাল থেইক্যা রিলিজ নিয়া চলে আসছি। চাবিও জমা দিয়া আসছি। আমার কেবিনে যে টেলিফোন ছিল, তাও বুঝাইয়্যা দিয়া আসছি। ডাক্তারই তো আমারে রিলিজ করতে চায় নাই, এইখানে আমার কী দোষ?’ মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ভালো করে যাচাই-বাছাই না করেই ভর্তি করে। ফলে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও এখানে থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। কেবিনে বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রম হয় বলেও অভিযোগ করলেন ওই মুক্তিযোদ্ধা।

মঙ্গলবার কমান্ডার লেখা তালাবদ্ধ ১৫ নম্বর কেবিনের সামনে যেতেই এক মুক্তিযোদ্ধা বললেন, ‘এই কেবিন যাঁর, তাঁর তো কেবিনের মালিকানায় “লাইফটাইম গ্যারান্টি” আছে। তিনি না থাকলেও কেবিনের চাবি থাকে তাঁর কাছে।’ জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কর্মরত ব্যক্তিরা জানালেন, ওই মুক্তিযোদ্ধাকে বাড়ি পাঠানো সম্ভব হলেও কেবিনের দখল নিতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই মুক্তিযোদ্ধার টেলিফোন নম্বর পাওয়া গেল না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। তাই তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহেদুর রহমান খান বলেন, কেবিন দখলের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সবার নজরে আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি ‘সংবেদনশীল’ হওয়ায় কেউ কথা বলেন না। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাঁদের অনেক বুঝিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়। পরের দিনই অন্য কোনো ইউনিটে এসে ভর্তি হন তাঁরা। তখন আর বলার কিছু থাকে না। রাজনৈতিক তদবির তো আছেই। আগামী এক বছরের মধ্যেই হাসপাতাল ভবন ভেঙে নতুন ভবন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হবে। তখন আর আলাদা করে মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ড বা কেবিন থাকবে না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা পুরো হাসপাতালেই তাঁদের প্রাপ্য সেবা ও সম্মান পাবেন বলে জানালেন পরিচালক।