গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কত দূর?

একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে গতি নেই। গত বছর থেকে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন শুরু হয় এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধাপ অতিক্রম করতে পারেনি বাংলাদেশ।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এর আগে বেসরকারি উদ্যোগে ২০০১ সালে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালনের দাবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথমবার তোলা হলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে তা এগোয়নি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দিলে সে সুযোগ হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দেশব্যাপী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশীয় সহযোগীদের নিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায়। সরকারি হিসাবে, ওই সময়ে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ২৫ মার্চ রাতে কয়েক ঘণ্টার হত্যাকাণ্ডকে সবচেয়ে ভয়াবহ চিহ্নিত করে সেটিকে কালরাত্রি বলে ডাকা হয়। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত অভিযানে হাজার হাজার বাঙালিকে কয়েক ঘণ্টায় হত্যা করা হয়েছিল। ওই রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন ইপিআর সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালিদের ওপর বন্দুক ও কামান নিয়ে হামলা চালায়। একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি স্মরণ করে গত বছর থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়েছে। গত বছরের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে এ দিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করার পাশাপাশি একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য একটি বিল পাস করা হয়।

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য আমরা জাতিসংঘের ইউনেসকো এবং গণহত্যার ভুক্তভোগী বিভিন্ন দেশকে চিঠি লিখেছি। বাংলাদেশ স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টিতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর “আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস” পালনের ঘোষণা করা হয়। এ প্রস্তাবে সমর্থন দেয় বাংলাদেশসহ ১৯৩টি সদস্য দেশের সদস্যরা। এ কারণে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের সুযোগ নেই।’

শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘এই সুযোগ হারানোর কারণে এখন আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য। এ স্বীকৃতি অর্জনের পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে গত বছরের ১৪ মার্চ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তিনটি প্রস্তাবও দেয়।’

তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে দাবি করেন শাহরিয়ার কবির। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে—এমন তথ্যও তাঁরা পাননি।

শাহরিয়ার কবির বলেন, ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোসহ যেসব দেশ একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিল, তাদের অনুরোধ করলেই দেশগুলো তাদের পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করবে বলে আশা করা যায়। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওনের মতো ছোট ছোট দেশ তাদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছে। সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে নয় মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি অবশ্যই পাওয়া যাবে। এর জন্য কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু পাকিস্তান নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া আমেরিকা ও চীনের সমর্থন আদায়েও কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ২০০১ সালে ইউনেসকোর কাছে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি ব্যক্তিগতভাবে তিনি প্রথম তুলেছিলেন। ২০০৪ সালে ইউনেসকোর কাছে ২৫ মার্চকে গণহত্যা প্রতিরোধ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন করেন। জবাবে ইউনেসকো জানিয়েছিল, স্বীকৃতি পেতে হলে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে জাতিসংঘে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতি নিয়ে তা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করতে হবে। ২০০৯ সালে তিনি সরকারের কাছে তা তুলে ধরলেও সরকার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

এম এ হাসান বলেন, ‘সরকারের বিলম্বিত উদ্যোগের কারণে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের সুযোগ আমরা হারিয়েছি। এখন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় করতে পারে বাংলাদেশ। সে সুযোগ এখনো রয়েছে।’

এম এ হাসান আরও বলেন, এ ব্যাপারে দেশ-বিদেশের গণহত্যা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে স্বীকৃতি আদায়ের কৌশলগুলো ঠিক করতে পারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘে প্রস্তাবের জন্য অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হবে। প্রথমে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে তাদের পার্লামেন্টে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণহত্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোনো রেকর্ডে এখনো স্বীকৃত নয়। যুক্তরাজ্যের ইম্পিরিয়াল ওয়্যার মিউজিয়ামেও এ ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। তবে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন শুরু হওয়ায় বিষয়টি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরুত্ব পাবে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য সরকারের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে বলে প্রথম আলোকে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আদায়ে সরকারিভাবে অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। তবে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। ২৫ মার্চের গণহত্যাকে স্মরণ করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কাছে চিঠি পাঠানো হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও মৌখিকভাবে ২০ থেকে ২৫টি দেশ স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে।

ইতিমধ্যে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালন শুরু করেছে জাতিসংঘ। সে ক্ষেত্রে ২৫ মার্চকে নতুন করে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের স্বীকৃতি আদায় সম্ভব কি না, তা জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেখা যাক কী হয়।’

গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতি না হলেও মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ে সরকার উদ্যোগ নেবে কি না, এ প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে বলে জানালেন পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোনো দেশকে এখন পর্যন্ত অনুরোধ জানানো হয়েছে কি না, তা জানতে চাইলে তিনি তা স্পষ্ট করেননি। বলেছেন, এখানে অনেক প্রক্রিয়ার বিষয় আছে।