ঢাকা এখন গডফাদারদের শহর

>
  • গোলটেবিলে একাধিক আলোচকের মত।
  • ঢাকা বর্তমানে নাগরিকদের শহর নয়।
  • চাঁদা আদায় করছে গডফাদাররা।
  • চাঁদার টাকা ভাগ হয়।

গতকাল শনিবার ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট: আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শিরোনামে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক ছিল বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।

এই বৈঠকে একাধিক আলোচক বলেন, ঢাকা বর্তমানে নাগরিকদের শহর নয়, ‘গডফাদারদের’ শহর। ঢাকার কয়েক লাখ অনিবন্ধিত রিকশা এবং ফুটপাতের কয়েক হাজার অবৈধ হকারের কাছ থেকে চাঁদা আদায়কারীদের গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আলোচকেরা বলেন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতেও গডফাদারদের দৌরাত্ম্য। তাই যাত্রীসেবার বদলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ঢাকা ও এর আশপাশে বাস-মিনিবাস চলাচল করে প্রায় সাত হাজার। অন্তত এক ডজন মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনীতিক সরাসরি এই পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। এঁদের অনেকে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতা হয়ে নিয়ন্ত্রণ করেন। আবার কেউ কেউ সরাসরি নিজেই বাস নামিয়ে ব্যবসা করছেন।

পরিবহন সূত্রগুলো বলছে, ওয়েবিল (যাতায়াতের হিসাব), জিপি (গেট পাস), পার্কিং চার্জ, মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের চাঁদা—এসব নামে প্রতিদিন প্রতিটি বাস-মিনিবাস থেকে ৭০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হয়। এই চাঁদার টাকা পরিবহননেতা, মালিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পকেটেও যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আসছে না। এই খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করা গেলে যাত্রীভাড়া আরও কমে যেত। ভোগান্তিও থাকত না।

হকার সমিতিগুলোর হিসাবে, ঢাকার ফুটপাতে ৫০-৬০ হাজার হকার আছেন। রাস্তায় থাকা হকারদের ধরলে সংখ্যাটা ১ লাখে দাঁড়ায়। প্রত্যেক হকারের কাছ থেকে গড়ে দিনে ১৫০ টাকা আদায় করা হয়। সে হিসাবে হকারদের কাছ থেকেই দৈনিক চাঁদা আদায় হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা।

গত বছরের প্রথম ভাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কিছু কিছু এলাকার হকারদের সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়। সেই হিসাবে, গুলিস্তান এলাকায় শুধু ফুটপাতে হকার আছে আড়াই হাজার। নিউমার্কেট এলাকায় পৌনে নয় শ।

অভিযোগ রয়েছে, চাঁদার এই টাকা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পুলিশ ও চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত লাইনম্যান এবং তাঁদের সহযোগীরা ভাগ করে নেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি আবুল কাসেম প্রথম আলোকে বলেন, চাঁদাবাজেরা হকারদের কাছ থেকে যে পরিমাণ চাঁদা আদায় করে, এটা সরকার নিজে তুললে হকারদের পুনর্বাসন হয়ে যেত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও হকারদের পুনর্বাসন হচ্ছে না। চাঁদাবাজেরা পকেট ভারী করছেন।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় নিবন্ধিত বৈধ রিকশা আছে ৮০ হাজার ৪৭৩টি। ১৯৮৬ সালের পর আর কোনো রিকশার নিবন্ধন দেওয়া হয়নি। তবে রাজধানীতে চলে প্রায় পৌনে ৭ লাখ রিকশা। উৎসব-পার্বণে রিকশার সংখ্যা বেড়ে ১০ লাখে দাঁড়ায়। সরকার-সমর্থক বিভিন্ন সংগঠন মুক্তিযোদ্ধাদের নামে রিকশার নিবন্ধন দিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে পুলিশ ও সিটি করপোরেশন অভিযান চালিয়ে কিছু কিছু রিকশা জব্দ করে। এরপর সেগুলো সাংসদ, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গ্রামের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণের নামে পুনরায় নিজ দলের লোকদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করা হয়।

গতকাল গোলটেবিল বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এ শহরকে নাগরিকদের বসবাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। সরকারি সংস্থাগুলোকে এ ক্ষেত্রে নাগরিক সেবার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নিবন্ধিত নির্দিষ্ট সংখ্যক রিকশা, ফুটপাত হকারমুক্ত করা, বাস, লঞ্চ টার্মিনালগুলো সরকারি সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হবে।