উপাচার্য মাঝেমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান

নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ
নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ
• কোষাধ্যক্ষসহ ছয় পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন উপাচার্য।
• ২১ কোর্সের দায়িত্বেও তিনি।
• তাই ক্যাম্পাসে না থাকলে প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রমে সমস্যা হচ্ছে।


রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ মার্চ গিয়ে জানা গেল, উপাচার্য অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ক্যাম্পাসে নেই। তিনি ঢাকায় আছেন। পরের দিন বেলা সোয়া তিনটায় আবারও গেলে তাঁর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ‘উপাচার্য আজ (১৫ মার্চ) রংপুর আসবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বনভোজনে (১৬ মার্চ) অংশ নিতে আসার কথা।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা বললেন, উপাচার্য বেশির ভাগ সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন না। সপ্তাহে দু-এক দিন ক্যাম্পাসে থেকে আবার ঢাকায় চলে আসেন। কোনো কোনো সময় ঢাকা থেকে সকালের ফ্লাইটে সৈয়দপুরে নেমে সেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবার ওই দিন বিকেলের ফ্লাইটে ঢাকায় চলে আসেন। তাঁর এমন উপস্থিতিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা বলেন, ‘উপাচার্য স্যার মাঝেমধ্যে আসেন।’

প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায়, উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার সাড়ে নয় মাসে সব মিলিয়ে তিন মাসের মতো তিনি ক্যাম্পাসে ছিলেন। বাকি সময় মূলত ঢাকায় ছিলেন। অথচ রাষ্ট্রপতি ও আচার্য তাঁকে যে চারটি শর্তে নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁর একটি হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে উপাচার্যকে সার্বক্ষণিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতে হবে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উপাচার্যের জন্য বাড়ি করে দিয়েছে সরকার।

একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নেই। উপাচার্য তাঁর মূল পদের বাইরে কোষাধ্যক্ষসহ অন্তত ৬টি পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২১টি কোর্সের দায়িত্বেও তিনি। ফলে উপাচার্য ক্যাম্পাসে না থাকায় প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রমে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

‘আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে’ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ চলতি বা ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দিয়ে চালানো এবং স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তিতে জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও বিচার না করার অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। নিয়োগে অনিয়মসহ বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে লিখিতভাবে এসব অভিযোগ করেছে শিক্ষকদের একটি অংশ।

জানতে চাইলে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়জন কর্মকর্তা আবাসিক, এর মধ্যে উপাচার্য একজন। সুতরাং উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে থাকতেই হবে, এটা তাঁর দায়িত্ব। অভিযোগ পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো দেখে বলতে হবে।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুল জলিল মিয়াকে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছিল। সর্বশেষ সাবেক উপাচার্য এ কে এম নূর-উন-নবীর বিরুদ্ধেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তিনি মেয়াদ শেষ করলেও রংপুর ছাড়তে হয় অনেকটা গোপনে। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা এসব ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বর্তমান উপাচার্যও আগের উপাচার্যদের পথে হাঁটছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্যের বক্তব্য নিতে এই প্রতিবেদক পরপর দুই দিন ক্যাম্পাসে গিয়েও তাঁকে পাননি। পরে ২০ মার্চ মুঠোফোনে কল করলে মুঠোফোনে চার্জ শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে জানান। পরে একাধিকবার ফোন করলেও আর ধরেননি। ২১ মার্চও তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। বেলা আড়াইটার দিকে একবার খুদে বার্তা পাঠিয়ে তিনি জানান, এই মুহূর্তে কথা বলতে পারবেন না। পরে আবার পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি। গতকালও একাধিকার ফোন করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ বিভাগের মাধ্যমেও বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

গত বছরের ১ জুন রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মো. আবদুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে চার বছরের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন। সরেজমিনে জানা যায়, উপাচার্য শুরুতে কিছুদিন পরিবার নিয়ে ক্যাম্পাসে ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই পরিবার ঢাকায় চলে আসে। এরপর থেকে উপাচার্য বেশির ভাগ সময় ঢাকায় থাকতে শুরু করেন। উপাচার্য নিয়মিত ক্যাম্পাসে না থাকলে নানা সমস্যা হয় বলে জানালেন দুজন শিক্ষক। তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, যেমন উপাচার্য লোকপ্রশাসন ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মোট ২১টি কোর্সের দায়িত্বে আছেন। একজন অধ্যাপক হিসেবে তিনি পড়াবেন, এটা ভালো। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেহেতু অধিকাংশ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকেন না, ফলে এটা হিতে বিপরীত হয়েছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, একটি কোর্সের জন্য সপ্তাহে দুটি ক্লাস নিতে হয়। সেই হিসাবে তাঁর সপ্তাহে ৪২টি ক্লাস নেওয়ার কথা। এ ছাড়া আছে ইনকোর্স, মিডটার্ম, অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশন। কিন্তু উপাচার্য ক্লাসসহ এসব কাজ নিয়মিত করতে পারছেন না। লোকপ্রশাসন বিভাগের এক শিক্ষক প্রথম আলোক বলেন, উপাচার্য হওয়ায় কেউ এ বিষয়ে কিছু বলতেও পারছেন না।

কোষাধ্যক্ষের পদ থাকলেও এই পদটি বর্তমান উপাচার্যের অনেক আগে থেকেই শূন্য। ফলে এই পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন উপাচার্য। ডিন হওয়ার মতো অধ্যাপক থাকার পরও সামাজিক বিজ্ঞানের ডিনের পদ উপাচার্য নিজের হাতে রেখেছেন। এ ছাড়া জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানসহ (বিভাগীয় প্রধান হওয়ার মতো শিক্ষক রয়েছেন) ৬টি পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন উপাচার্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক বলেন, উপাচার্য ঢাকায় গেলে কাউকে উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়ে যান না। ফলে প্রশাসনিক কাজে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।

অন্তত ৪০ পদ চলতি বা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে চলছে
একাধিক শিক্ষক ও কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান উপাচার্য ‘আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ চলতি দায়িত্ব দিয়ে চালাচ্ছেন। উপাচার্যের পদগুলো ছাড়াও অন্তত ৪০টি পদে এখন চলতি দায়িত্বে বা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে রয়েছেন শিক্ষক-কর্মকর্তারা। এর মধ্যে রয়েছে প্রক্টর ও চার সহকারী প্রক্টর, তিনটি হলের তিনজন প্রভোস্ট ও ২৩ জন সহকারী প্রভোস্ট, ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা প্রশাসক ও দুজন সহকারী প্রশাসক, বহিরাঙ্গন কার্যক্রম পরিচালক, সাইবার সেন্টারের পরিচালক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ই-লার্নিং সেন্টারের পরিচালক, অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক।

অভিযোগ উঠেছে, উপাচার্য নিজের পছন্দের একশ্রেণির শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিভিন্ন পদে বসাচ্ছেন। উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ একজন শিক্ষকও প্রথম আলোকে বলেন, চলতি দায়িত্ব দেওয়া উপাচার্যের একটি কৌশল। তিনি দেখতে চেয়েছেন কারা তাঁর বিশ্বস্ত। সেটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। এখন আস্তে আস্তে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে।

নিয়োগ নিয়ে অভিযোগ
একাধিক বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে তুলনামূলক ভালো ফলধারী প্রার্থীকে বাদ দিয়ে তুলনামূলক পিছিয়ে থাকা প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি গণিত বিভাগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত একটি বিভাগে একজন মেধাবী ও অতিদরিদ্র ছাত্রীকে বাদ দিয়ে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই ছাত্রী রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। পরে তিনি আরেকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।

জনবলকাঠামোর বাইরে গিয়েও কিছু কিছু পদে দায়িত্ব দিয়েছেন উপাচার্য। যেমন জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগে একজন শিক্ষককে প্রশাসক এবং অপর দুই শিক্ষককে সহকারী প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় বর্তমান প্রশাসন। অথচ এই শাখার মূল ব্যক্তিকে অন্য বিভাগে বদলি করা হয়েছে। ‘কাজ নাই, মজুরি নাই’ ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ কমিটি যথাযথ নিয়ম মেনে না করার অভিযোগ রয়েছে। এমনও কমিটি গঠন করা হয়েছে, যেখানে নিজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাকে (পিএ) সদস্যসচিব করা হয়েছে।

শিক্ষকসংকট
ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১: ১৯। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১: ৫৩। কিছু বিভাগে এই অনুপাত অনেক বেশি। যেমন লোকপ্রশাসন বিভাগে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১: ৯২। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ১: ৯০। এর ফলে শিক্ষকদের ওপর যেমন প্রচণ্ড চাপ পড়ছে, তেমনি শিক্ষার্থীরা কার্যত ভালো শিক্ষা পাচ্ছেন না।

অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকস্বল্পতা থাকলেও নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনই সমস্যা করছে। সাতটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের জন্য সাক্ষাৎকার (মৌখিক পরীক্ষা) হলেও প্রায় এক বছর ধরে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। আবার এই সাত বিভাগের বাইরে নতুন করে পাঁচটি বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী আট হাজারের কিছু বেশি। শিক্ষক আছেন ১৫২ জন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগের শিক্ষক আপেল মাহমুদের মূল্যায়ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়টি ভালোভাবে চলছে না।