এবার নয়, পরেরবার ব্যবস্থা নেবে পুলিশ

পাহাড় কেটে চলছে প্লট বানানোর কাজ। গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানার চৌধুরীনগর এলাকায়।  ছবি: সৌরভ দাশ
পাহাড় কেটে চলছে প্লট বানানোর কাজ। গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানার চৌধুরীনগর এলাকায়। ছবি: সৌরভ দাশ

আসামিদের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগের নেতা, অন্যজন নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেন। চট্টগ্রাম শহরের বায়েজিদ থানার অধীন দুটি এলাকায় পাহাড় কাটার ঘটনায় গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, আবার যদি ওই দুজন পাহাড় কাটেন, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অবশ্য পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়ার অপেক্ষায় কেউ বসে নেই। পাহাড় কেটে সাফ করে সেখানে প্লট বানানোর কাজ চলছে। যে দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের একজন চট্টগ্রাম নগরের জালালাবাদ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য মো. বাহার উদ্দিন। অন্যজন একই ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা শামসুদ্দিন ওরফে বাদল। অবশ্য এই ওয়ার্ডে যুবলীগের কমিটি নেই। তাঁরা দুজন বায়েজিদ থানাধীন চৌধুরীনগর এবং চন্দ্রনগর এলাকায় পৃথক দুটি পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করছেন বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিদিন রাতে পাহাড় কাটার পর দিনে চলে প্লট নির্মাণের কাজ। কেউ যাতে সহজেই বিষয়টি বুঝতে না পারে, সে জন্য প্রতিটি প্লটের সীমানার চারপাশে কলাগাছ লাগানো হচ্ছে। দুই নেতার দাবি, তাঁরা পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত নন। তবে পাহাড় কেটে বানানো প্লটের মধ্যে কয়েকটি পুলিশ পাবে, এমনটি শুনেছেন তাঁরা।

বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম বলেন, ওই দুটি এলাকায় যদি আবার পাহাড় কাটা হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা।

বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের টেক্সটাইল মোড় থেকে বাঁ দিকে এক কিলোমিটার গেলে চন্দ্রনগর এলাকা। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে আরও এক কিলোমিটার এগোলে চৌধুরীনগর। দুটি এলাকাতেই শিল্পকারখানা রয়েছে। এখন পাহাড় কেটে বসতিও গড়ে উঠছে।

চৌধুরীনগর এলাকায় পাহাড় কাটার ঘটনায় গত ৭ ফেব্রুয়ারি বায়েজিদ থানায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে মামলা করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. তাহাজ্জত আলী। চৌধুরীনগরের যে এলাকায় পাহাড় কাটা হচ্ছে, সেটি হাসান সাহেবের খামারবাড়ি নামে পরিচিত।

মামলার প্রধান আসামি হাসান জাহিদুল ইসলাম স্থানীয় বাসিন্দা। বাদল ২ নম্বর এবং বাহার ৩ নম্বর আসামি। মোট ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, চৌধুরীনগরে এক একরের সমপরিমাণ পাহাড় কাটা হয়েছে।

সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার চৌধুরীনগর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খাড়াভাবে পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ের যে অংশ সমতল করা হয়েছে সেখানে সীমানাদেয়াল তুলে প্রায় ১০টি প্লট করা হয়েছে। প্রতি প্লটের আয়তন ৭-৮ কাঠা। মাটি কাটায় নিয়োজিত দুজন শ্রমিক বলেন, এগুলো পুলিশের প্লট। আওয়ামী লীগ নেতা বাহার প্লট বানাচ্ছেন।

অভিযোগের বিষয়ে বাহার উদ্দিন বলেন, এ পাহাড়ের মালিক সরকার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ইন্ধনে তাঁকে ও তাঁর বন্ধু বাদলকে মামলার আসামি করা হয়েছে। পাহাড় কেটে বানানো প্লট কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও ওয়াসার লোকজন কিনেছেন বলে শুনেছেন তিনি।

নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় দুজন বাসিন্দা বলেন, বায়েজিদ থানার কয়েকজন পুলিশকে প্লট দেওয়ার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নির্বিঘ্নে ওই দুই নেতা পাহাড় কাটছেন। এর সঙ্গে বায়েজিদ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) গোলাম মোহাম্মদ নাসিম ও মঞ্জুর হোসেন জড়িত বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।

এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই গোলাম মোহাম্মদ বলেন, তিনি চৌধুরীনগর এলাকায় কোনো পাহাড়ি ভূমি কেনেননি।

এ বিষয়ে এসআই মঞ্জুরের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

চৌধুরীনগর এলাকার পাহাড় কাটার মামলায় প্রধান আসামি স্থানীয় বাসিন্দা হাসান জাহিদুল ইসলাম। তিনিও বলেন, যেখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে তা সরকারি জমি। তাঁর বিরুদ্ধে ভুলে পরিবেশ অধিদপ্তর  মামলা করেছে বলে দাবি করেন তিনি। মামলার আসামি ওই দুজনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ রয়েছে বলে জানান তিনি।

চৌধুরীনগর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে চন্দ্রনগর এলাকায় কিষোয়ান ফ্যাক্টরির (একটি বেকারি কারখানা) অবস্থান। এই কারখানার ঠিক পেছনে কাটা হচ্ছে আরেকটি পাহাড়। গত বৃহস্পতিবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফ্যাক্টরির পেছনে প্রায় ৬০ ফুট উঁচু একটি পাহাড় কাটা হয়েছে। খাড়াভাবে কাটার কারণে যেকোনো সময় ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

চন্দ্রনগর এলাকায় এখনো পাহাড় কাটা হচ্ছে বলে স্বীকার করেন আওয়ামী লীগ নেতা বাহার। তবে কে কাটছে, তা জানেন না বলে দাবি করেন তিনি।

চন্দ্রনগরে পাহাড় কাটার অভিযোগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামলা করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. ফখর উদ্দীন চৌধুরী। এজাহারে উল্লেখ করেন, সেখানে প্রায় চার হাজার বর্গফুটের বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে। এ মামলায় বাহারকে ১ নম্বর ও বাদলকে ২ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

স্থানীয় দুই বাসিন্দা বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করার পর কিছুদিন পাহাড় কাটা বন্ধ ছিল।

যুবলীগ নেতা বাদল বলেন, চন্দ্রনগরে যেখানে পাহাড় কাটা হচ্ছে সেখানে তাঁর ও বাহারের বাড়ি। কারা পাহাড় কাটছে তিনি জানেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ইন্ধনে মামলায় জড়ানো হয়েছে তাঁদের। তবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কারা, তা স্পষ্ট করে বলেননি তিনি।

এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক নাজনীন আক্তার বলেন, পাহাড় কাটার মামলায় শিগগিরই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

যে দুটি এলাকায় পাহাড় কাটা হচ্ছে, তা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জালালাবাদ ওয়ার্ডে পড়েছে। এ বিষয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহেদ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড় কারা কাটছে, তা মেয়র ও জেলা প্রশাসক দেখবেন। পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করতে দুজনকেই চিঠি দিয়েছেন তিনি। তাঁরা উদ্যোগ নিলে ভালো হবে।