আধা কিলোমিটার সড়কে থইথই পানি

পশ্চিম ভাষানটেকের মজুমদার পাড়া মোড়ে জমে আছে পানি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, চার মাস ধরে চলছে এই অবস্থা। দৃশ্যটি গতকাল ক্যামেরাবন্দী করা হয়।  প্রথম আলো
পশ্চিম ভাষানটেকের মজুমদার পাড়া মোড়ে জমে আছে পানি। স্থানীয় লোকজন বলছেন, চার মাস ধরে চলছে এই অবস্থা। দৃশ্যটি গতকাল ক্যামেরাবন্দী করা হয়। প্রথম আলো
>
• চার মাস ধরে একটি সড়কে পানি জমে আছে 
• পানিবন্দী হয়ে পড়েছে পশ্চিম ভাষানটেক, দেওয়ানপাড়া এলাকার হাজারো মানুষ


চৈত্র মাস। কাঠফাটা রোদ। ঝুমবৃষ্টির দেখা নেই বেশ কিছুদিন। কিন্তু সড়কে জমে আছে হাঁটুপানি। চার মাস ধরে এ অবস্থা চলছে রাজধানীর পশ্চিম ভাষানটেকের একটি সড়কে। এতে কার্যত পানিবন্দী হয়ে পড়েছে পশ্চিম ভাষানটেক, দেওয়ানপাড়া এলাকার হাজারো মানুষ।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালেক মোল্লাহ এবং ভাষানটেক থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজমত দেওয়ানের সম্পর্কের টানাপোড়েনে পয়োবর্জ্য এবং পানিনিষ্কাশনের নালার কাজ শুরু হচ্ছে না। খোদ কাউন্সিলরও জানেন না এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে ঠিক কবে মুক্তি মিলবে এলাকাবাসীর।

গতকাল সোমবার ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিম ভাষানটেকের মজুমদারের মোড় থেকে জলাবদ্ধতার শুরু; যা দেওয়ানপাড়ার কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে। প্রায় আধা কিলোমিটার সড়কে জমে আছে নোংরা পানি। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন এলাকাটিতে পানিনিষ্কাশনে কোনো নালা নেই। রাস্তার পাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি পুকুরে জমা হতো বাসাবাড়ির পয়োবর্জ্যমিশ্রিত পানি। বাসিন্দারা নিজেদের উদ্যোগে বাড়ি থেকে ওই পুকুরে পয়োবর্জ্য যাওয়ার নালা করে নিয়েছিলেন। কয়েক মাস আগে জলাশয়টি ভরাট করে ফেলায় বর্জ্যমিশ্রিত পানি যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। ফলে পয়োনালার পানি জমছে সড়কে।

হাঁটুপানি মাড়িয়েই পথ চলছিলেন বৃদ্ধ ফয়জার রহমান। তিনি বলেন, পুরো শহরেই সড়ক ও নালা সংস্কারের কাজ চলছে। কিন্তু পশ্চিম ভাষানটেকে নালার কাজ শুরু করার কোনো লক্ষণই নেই। চার মাস ধরে বর্জ্যমিশ্রিত পানি জমতে জমতে এই সড়কটি বদ্ধ ডোবায় পরিণত হয়েছে। এতে ঘনবসতিপূর্ণ এই অঞ্চলে যেকোনো সময় রোগবালাই মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এরই মধ্যে এলাকা ছাড়তে শুরু করেছেন ভাড়াটেরা। মঞ্জুর হোসেন নামের এক বাসিন্দা ভ্যানে করে বাসাবাড়ির মালপত্র সরাচ্ছিলেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী বলা হয়। এই তার অবস্থা। আমার ছোট বাচ্চাটিকে প্রতিদিন ময়লা পানি মাড়িয়ে স্কুলে যেতে হয়। এই এলাকায় আর এক মুহূর্ত নয়।’

এদিকে বাসার তিন ভাড়াটে চলে যাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয় আমার। বাড়ি ভাড়ার টাকাই ছিল সম্বল। শুষ্ক মৌসুমে রাস্তার এই দশা। আসছে বর্ষায় কী হবে? কিছু ভাবতে পারছি না।’

দেওয়ানপাড়া থেকে ভাষানটেক বাজার হয়ে শহরের অন্য এলাকায় যাওয়ার একমাত্র পথ এটি। চার মাস ধরে নোংরা পানি জমে থাকায় দেওয়ানপাড়ার হাজারো বাসিন্দার ভোগান্তি উঠেছে চরমে।

এই সড়কেই রয়েছে ভাষানটেক জামিয়া মোহাম্মদিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা। জলাবদ্ধতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ রয়েছে কয়েক মাস ধরে। এলাকার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এই সড়ক দিয়েই পশ্চিম ভাষানটেক কবরস্থানে যেতে হয়। ভাবুন একবার, পবিত্র হয়ে লাশ দাফন করাও যাচ্ছে না। রমজান মাসে কী হবে জানি না।’

ঘুরে দেখা গেল, বেশ কিছু বাড়িতেও ঢুকে পড়েছে নোংরা কালো পানি। ইট-সুরকিভর্তি বস্তা ফেলে বাসায় যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে নিয়েছেন কেউ কেউ। এ রকম একটি বাড়ির মালিক প্রকৌশলী ইউসুফ মামুন বলেন, ‘কেউ তো কিছু করছে না, তাই নিজ খরচে বস্তা ফেলছি। বাজার থেকে এখানে রিকশা ভাড়া ছিল ১৫ টাকা। এখন দিনের বেলা তা ৫০ টাকা। আর রাত নামলে ১০০ টাকার কম কেউ আসতে চায় না।’

দুই নেতার দ্বন্দ্বে থেমে আছে সংস্কারকাজ
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, রাস্তা ও নালার কাজ শুরু না হওয়ার পেছনে মূল কারণ স্থানীয় দুই নেতার দ্বন্দ্ব। ২০১৫ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন ভাষানটেক থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজমত দেওয়ান। তিনি দলের বিদ্রোহী প্রার্থী সালেক মোল্লাহর কাছে হেরে যান। এরপর থেকেই চলছে দুজনের রেষারেষি। আজমত দেওয়ান থাকেন দেওয়ানপাড়ায়। এই রাস্তা দিয়েই সেখানে যেতে হয়। তাই রাস্তা সংস্কারে কাউন্সিলরের কোনো উদ্যোগ নেই। পাশাপাশি কাউন্সিলরের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বাদ সাধেন আজমত দেওয়ান।

কাউন্সিলরের অফিসের কর্মকর্তারা জানান, ভাষানটেক বাজার থেকে দেওয়ানপাড়া বেইলি ব্রিজ পর্যন্ত সড়ক সংস্কার ও পয়োনালা নির্মাণের জন্য প্রায় নয় কোটি টাকা দরকার। অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। সাময়িকভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএনসিসির ২ নম্বর অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী এলাকাটি পরিদর্শন করেছেন।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর সালেক মোল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী অস্থায়ী ভিত্তিতে নালা তৈরির কথা বলেছেন। এ জন্য ১৬-১৭ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই বাজেট সিটি করপোরেশনে পাস হয়ে কবে নাগাদ কাজ শুরু করা যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতার সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে আমার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার মাধ্যমেই এলাকার উন্নয়নকাজ আগেও হয়েছে, বর্তমানেও হবে।’

আর আজমত দেওয়ান বলেন, ‘নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকে। এ নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। সালেক মোল্লাহ ১৪ বছর ধরে কাউন্সিলর। কী উন্নয়ন করেছেন, সাধারণ মানুষ বিচার করবে। আমি নিজ উদ্যোগে রাস্তা সংস্কারের চেষ্টা করছি। এ জন্য কটু কথা শুনতে হয়েছে।’