ভিআইপি হজ প্যাকেজে সাবধান

সম্প্রতি মন্ত্রিসভা হজ প্যাকেজের খসড়ায় অনুমোদন দিয়েছে। কেউ কেউ ভিআইপি প্যাকেজে হজে যেতে চাইবেন। গতবারের হজে বাংলাদেশের কিছু কিছু হাজি বিলাসবহুল প্যাকেজের মাধ্যমে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হন। বাংলাদেশ থেকে ভিআইপি প্যাকেজে হজ করতে আসা এমন ৮০ জনের খোঁজ পান এ প্রতিবেদক। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক হওয়ার কারণে তাঁদের নাম-পরিচয় গোপন রাখতে হচ্ছে। 

বিলাসবহুল হজ প্যাকেজ, যা ভিআইপি প্যাকেজ নামে বেশি পরিচিত। ভিআইপি প্যাকেজ ১৫ থেকে ২০ দিন। খরচ ৫ লাখ থেকে ১৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। এত টাকা দেওয়ার পরও কেন বিড়ম্বনা?
এ প্রতিবেদনে নেপথ্য কারণগুলো খোঁজার চেষ্টা করা হবে। মূলত তথ্য না জানা এবং কৌশলগত কারণেই হজযাত্রীরা প্রতারিত হন। মক্কায় যে কক্ষের ভাড়া ৩ জিলহজ পর্যন্ত ১০ হাজার রিয়াল, সেই কক্ষ জিলহজের ৪ তারিখ থেকে এক লাখ সৌদি রিয়াল হয়। অর্থাৎ তারিখ অনুযায়ী ভাড়া কমবেশি হয়।
ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা সরল বিশ্বাসে এজেন্সির লোকের কথা বিশ্বাস করেছেন। পাঁচতারকা হোটেলে থাকার চুক্তিপত্র বা বুকিং আদৌ দেওয়া হয়েছিল কি না, তা-ও তাঁরা যাচাই করেননি। কারণ, বুকিং দিলে চুক্তিপত্র অথবা রিয়াল আদায়ের রসিদ থাকবে। এক দম্পতি ১২ লাখ টাকা খরচ করে মক্কায় পৌঁছে দেখেন, হিল্টন হোটেল তো দূরে থাক, কাবা শরিফ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিটার দূরের এক বাসায় তাঁদের থাকতে দেওয়া হয়।
বেশি টাকা দিয়েও হজ করতে এসে প্রতারিত হওয়া প্রসঙ্গে মক্কায় বসবাসকারী নাজমুল হক জানালেন, ভিসা হওয়ার আগে মক্কা-মদিনার বাসার কাগজপত্র ঠিক করতে হয়। বাসা ভাড়ার চুক্তির ফটোকপি হজযাত্রী এজেন্সির কাছে চাইতে পারেন। হজযাত্রী তা সংরক্ষণ করবেন। তাহলে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ কম। আরেকটি বিষয় হলো, কোন তারিখে, কোথায়, কত দিন থাকবেন, সংক্ষিপ্ত প্যাকেজ নাকি ফিতরা—এসব পরিষ্কার থাকা দরকার।
মক্কায় অনেক দিন ধরে বাস করেন আবুল কালাম। তিনি জানালেন, হজের দিন যত ঘনিয়ে আসে, অর্থাৎ ৪ জিলহজ থেকে ১৪ জিলহজ খরচ বেশি। আসলে ওই সময়ের বুকিংও আগে থেকে শেষ হয়। এ সময় বুকিং চাইলেও পাওয়া যায় না। কিছু হজযাত্রী চান, শেষ সময়ে হজে এসে দ্রুত দেশে ফিরতে। আর এ সময় খরচ বেশি। মসজিদুল হারাম-সংলগ্ন (কাবা শরিফ) হিল্টন টাওয়ার, জমজম টাওয়ার, সাফা টাওয়ার, মুভ অ্যান্ড পিক, রাইয়ান, মাকাম সুইট, রিতাজ টাওয়ার—সব কটিই চার বা পাঁচতারকা মানের হোটেল।
এসব টাওয়ারে বুকিং নিতে হলে আগে জামানত রেখে একটি অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। অ্যাকাউন্ট থাকলে এজেন্সির নিজস্ব ই-মেইলে রুমের বুকিং দেওয়া যায়। যাঁদের অ্যাকাউন্ট নেই, তাঁরা কারও মাধ্যমে বুকিং দিতে পারেন। মিসরীয় কোম্পানি মোল্লাক বা মাছারাতের মাধ্যমেও বুকিং নেওয়া যায়। সরাসরি টাওয়ারে লেনদেন হলে ঝুঁকি কম, খরচটা একটু বেশি।
যেমন, প্যাকেজ-১: ১ থেকে ২৫ জিলকদ রুম প্রতি খরচ ১২ থেকে ১৭ হাজার সৌদি রিয়াল। এক রুমে দুই থেকে চারজন থাকতে পারেন।
প্যাকেজ-২: জিলকদের ২৫ থেকে জিলহজের ৪ তারিখ রুম প্রতি খরচ ৮ থেকে ১৬ হাজার সৌদি রিয়াল।
প্যাকেজ-৩: ৪ জিলহজ থেকে ১৪ জিলহজ। খরচ রুমপ্রতি ৪২ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার সৌদি রিয়াল।
প্যাকেজ-৪: ১৪ জিলহজ থেকে ২৫ জিলহজ। খরচ রুমপ্রতি ১৮ থেকে ২০ হাজার সৌদি রিয়াল।
মক্কায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী হাফিজুর রহমান জানালেন, অনলাইনে বুকিং নিতে হলে ওয়েবসাইটে দেখাবে কোনো রুম খালি নেই। আবার কারও মাধ্যম হয়ে বুকিং দিলে সিট হিসেবে ভাড়া নেওয়া যায়। অর্থাৎ এক রুমে তিন থেকে চারজনের সিট হিসেবে ভাড়া নেওয়া যায়। এতে খরচ কমে।
সিট হিসেবে ভাড়ার নমুনা হলো—
প্যাকেজ ১: জিলকদ ১ থেকে ২৫ জিলকদ সিটপ্রতি খরচ ১৯০০ থেকে ২৩০০ সৌদি রিয়াল।
প্যাকেজ ২: জিলকদের ২৫ থেকে ৪ জিলহজ খরচ রুমপ্রতি ১০ হাজার সৌদি রিয়াল। এক রুমে দুই থেকে চারজন থাকতে পারেন।
প্যাকেজ ৩: ৪ জিলহজ থেকে ১৪ জিলহজ সিটপ্রতি খরচ ৩৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার সৌদি রিয়াল।
প্যাকেজ ৪: ১৪ জিলহজ থেকে ২৫ জিলহজ সিটপ্রতি খরচ ২০০০ থেকে ২৫০০ সৌদি রিয়াল।
এর বাইরে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরাও বুকিংয়ের কাজ করে দেন। প্যাকেজের তালিকা থেকে দেখা যায়, তারিখের ওপর খরচ ওঠানামা করে। যে রুম ৩ জিলহজ পর্যন্ত ১০ হাজার রিয়াল, সেই রুমই জিলহজের ৪ তারিখ এক লাখ রিয়াল।
এবার আসা যাক গাড়ি প্রসঙ্গে। হজের পাঁচ দিন মক্কা থেকে মিনা, মিনা থেকে আরাফাত, আরাফাত থেকে মুজদালিফা, মুজদালিফা থেকে মিনা, মিনা থেকে মক্কা, মক্কা থেকে মিনা, মিনা থেকে মক্কা। এসব জায়গায় প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি বাস বরাদ্দ থাকে। চাইলে চার-পাঁচজন করেও জিএমসি গাড়িতে যাতায়াত করা যায়। খচর ২৫ হাজার সৌদি রিয়াল।
ধরা যাক, কোনো হজযাত্রী ১৩৬ নম্বর মোয়াল্লেমের অধীনে নিবন্ধিত হলেন। পরবতী সময়ে তিনি জামারার কাছে ভিআইপি তাঁবু, যেমন ৬ নম্বর মোয়াল্লেমের অধীনে হজ করতে চান, তাহলে হজের অন্তত ২০-২৫ দিন আগে পাসপোর্ট, পিলগ্রিম আইডি, আগের বিলসহ মোয়াচ্ছাসায় আবেদন করতে হবে। কোটা খালি থাকা সাপেক্ষে মোয়াল্লেম ও টাকা স্থানান্তর হবে। বাড়তি টাকাও দিতে হবে।
মক্কায় অনেক দিন ধরে বসবাস করেন—এমন কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হজ শেষ হওয়ার পর কিছু ব্যবসায়ী অগ্রিম বেশ কিছু রুম বুকিং করে রাখেন। এক হাজার সিট কোনো কোনো টাওয়ারে ২০-২৫ লাখ রিয়ালে বুকিং করে। পরে হজ ঘনিয়ে এলে চড়া দামে ওই সিট বিক্রি করেন। এসব কাজে সংশ্লিষ্ট টাওয়ারের ম্যানেজার, মার্কেটিংয়ের লোক যুক্ত থাকেন। এতে ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি কম। চাকরির সুবাদে ম্যানেজার, মার্কেটিংয়ের লোক আড়ালে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অংশীদার হিসেবে কাজ করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হজ এজেন্সির মালিকেরাও এঁদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন।

টিপস
• ভিআইপি বলতে আপনি মক্কা, মিনা, মদিনা—তিনটি স্থানের জন্য ভিআইপি? নাকি একক স্থানের জন্য, তা জেনে নিন।
• এজেন্সি মালিকের সঙ্গে তথ্যগত কোনো অসংগতি (গ্যাপ) রাখবেন না। ই-হজের কারণে চাইলেও শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন না।
• রমজান মাসের মধ্যে আপনার কাঙ্ক্ষিত তারিখ অনুয়ায়ী হোটেল বুকিং, বিমান বুকিং, কাগজ দেখবেন, ঠিক আছে কি না। মিনার চুক্তি, বাড়িভাড়ার চুক্তি আরবিতে থাকলে তা অনুবাদ করে মিলিয়ে দেখুন।
• নিবন্ধন সনদ ও হজ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফরম-১৫ সংশ্লিষ্ট হজ এজেন্সির চুক্তির মূল কপি সংরক্ষণ করুন।
• ট্র্যাকিং নম্বর দিয়ে হজ ওয়েবসাইটে তথ্য যাচাই করুন।
• হজ ক্যালেন্ডার প্রিন্ট করে সে অনুয়ায়ী কাজের মনিটরিং করতে পারেন।