আশুগঞ্জ সার কারখানায় নিয়োগ-বাণিজ্য!

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানায় প্রায় তিন কোটি টাকার নিয়োগ-বাণিজ্য ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। আর সেই অভিযোগের তির কারখানার মহাব্যবস্থাপক (জিএম, প্রশাসন) আনোয়ার হোসেন এবং সিবিএর সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিনসহ অন্য নেতাদের দিকে।
তবে অনিয়মের অভিযোগ মেনে নিয়ে তাঁরা এ আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন। ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদে আবেদন করা মিণ্ঠু মুন্সি নামের এক প্রার্থী এরই মধ্যে নিয়োগের নানা অস্বচ্ছ দিক চিহ্নিত করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
টাকা দিয়েও চাকরি মেলেনি অনেকের। পরে অন্য প্রার্থীর কাছে বেশি টাকা পেয়ে ওই প্রার্থীর টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
দুদকের কাছে অভিযোগকারী মিণ্ঠু মুন্সি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডেটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগের নিশ্চয়তা দিয়ে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনোয়ার হোসেন আমার কাছ থেকে চার লাখ টাকা নেন। পরে তিনি অপারগতা প্রকাশ করে তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা ফেরত দেন। খরচ হয়ে গেছে জানিয়ে ২০ হাজার টাকা পরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পরে জানতে পারি অন্য প্রার্থীর কাছ থেকে বেশি টাকা পেয়ে তিনি আমার টাকা ফেরত দিয়েছেন।’
মিণ্ঠু মুন্সির অভিযোগ অস্বীকার করে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই নামের কাউকে আমি চিনি না।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এই কারখানায় সর্বশেষ নিয়োগ হয় ১৯৮৫ সালে। তবে ২০০৯ সালে বিভিন্ন পদে ১৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হলেও অনিয়মের অভিযোগে দুদক সেই নিয়োগ স্থগিত করে দেয়। বর্তমানে চাকরি ফিরে পেতে ওই ১৯ জন উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। এদিকে ২৯ বছরে অনেক পদ শূন্য হয়। এতে কারখানার সার্বিক পরিচালন ব্যবস্থায় নেমে আসে স্থবিরতা। এ অবস্থায় কর্তৃপক্ষ কিছু শূন্য পদ পূরণের উদ্যোগ নেয়। গত বছর ১ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ১৯টি শূন্য পদের বিপরীতে ৭৫ জনকে নিয়োগের জন্য আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। আবেদন পড়ে প্রায় চার হাজার। কিছু পদে লিখিত এবং কিছু পদে মৌখিক পরীক্ষা হয়। চলতি বছর ১ জানুয়ারি বিসিআইসির বোর্ডরুমে এসব নিয়োগ-প্রক্রিয়া চূড়ান্ত অনুমোদন পায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আইনি জটিলতার কারণে ৭৫টির মধ্যে ১৬টি পদের নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্থগিত আছে। বাকি ৫৯টি পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে গড়ে পাঁচ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়। সেই হিসেবে এই ৫৯ জনের কাছে নেওয়া হয় দুই কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকার কোনো হিসাব মহাব্যবস্থাপক বা সিবিএ নেতারা দিতে পারেননি।
নানা অনিয়ম: প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, ৫৯টি পদে নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম হয়েছে। কুরিয়ার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এলএমএসএস পদের জন্য আবেদন করা প্রার্থীকে। অথচ তিনি পরীক্ষাতেই অংশ নেননি। অগ্নিনির্বাপক পদে প্রার্থীর উচ্চতার শর্ত মানা হয়নি। কয়েকটি পদে প্রার্থীর নির্ধারিত বয়সের চেয়ে বেশি বয়সীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা কোটা, পোষ্য কোটা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কোটা এমনকি নারী ও প্রতিবন্ধী কোটার কোনোটিই রক্ষিত হয়নি। সৈয়দা তাহমিনা খানম কক্সবাজার জেলা থেকে একমাত্র প্রার্থী ছিলেন। জেলা, মুক্তিযোদ্ধা ও পোষ্য—এই তিন কোটাতেই বিবেচ্য হলেও চাকরি-বঞ্চিত হয়েছেন সৈয়দা তাহমিনা খানম। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ১০, ময়মনিসংহ থেকে ১০, ঢাকা থেকে ১০, কুমিল্লা থেকে ছয় এবং বরিশাল থেকে আটজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে লিখিত পরীক্ষায়ও অনিয়ম দেখা গেছে। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, ডেটা এন্ট্রি, এলডিএ কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষারিক পদের আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা হয় সকাল নয়টায়, ১০টায় ও বেলা ১১টায়। তিন ধাপে পরীক্ষা হলেও প্রশ্ন ছিল একই। অভিযোগ আছে সিবিএ ও কর্মকর্তাদের পছন্দের প্রার্থীদের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ধাপে পরীক্ষা নেওয়া হয়। এতে তাঁরা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন দেখার সুযোগ পেয়ে যান। মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, কর্তৃপক্ষ যেভাবে পরীক্ষা নিতে বলেছে, সেভাবেই নেওয়া হয়েছে।
আত্মীয়করণ: সিবিএর সভাপতি জিন্নাত আলীর ছেলে মিজান আহমেদকে টালি ক্লার্ক পদে, দপ্তর সম্পাদক গাজী জমশেদের ভাগনি জামাই তারিকুল ইসলামকে টেলিফোন অপারেটর পদে, সাংস্কৃতিক সম্পাদক সরকার আমিনুল হকের ছেলে আবদুল্লাহ আল মাহমুদকে টেলিফোন অপারেটর, ক্রীড়া সম্পাদক জান্নাত হোসেনের পুত্রবধূ সুমী খানমকে টুলস কিপার পদে, সহসাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াবের আত্মীয় আতিকুলকে অগ্নিনির্বাপক পদে এবং জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক জারুকী আহমেদের ভাতিজা নুরুল ইসলামের জুনিয়র ক্লার্ক পদে চাকরি হয়েছে।
কিছু আত্মীয়করণের কথা স্বীকার করে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আনোয়ার হোসেন বলেন, যেহেতু সিবিএ আছে। সুতরাং, কিছু একটা হলেও হতে পারে। তবে তিনি নিজে আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন।
অর্থ লেনদেন এবং আত্মীয়করণের কথা অস্বীকার করে সিবিএ সাধারণ সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে কারখানার অবস্থান। তার পরও আমার ইউনিয়ন থেকে কেউ চাকরি পায়নি। আসলে অনেকে চাকরি পায়নি বলে ভুল বোঝাবুঝি আছে।’