'আমরা দুরু দুরু মন নিয়ে বসবাস করছি'

বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭ মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭ মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। যেকোনো দেশেই অপরাধ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন করা একটি দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার হবে না, তা হতে পারে না। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করছে বলে সব সুযোগ নিতে চায়, তাহলে এ সরকার কেন দায়িত্ব পালন করছে না?

বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১৭’-এর মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুলতানা কামাল এসব কথা বলেন। রাজধানীতে ডেইলি স্টার কার্যালয়ে কাপেং ফাউন্ডেশন এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নাগরিক সমাজের সচেতন, বিবেকবান প্রতিনিধিদের দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর চলতে দেওয়া হবে না—এ ধরনের অঙ্গীকার করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সুলতানা কামালসহ অনুষ্ঠানের অন্য অতিথিরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদনটির মোড়ক উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে আলোচকদের বক্তব্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিষয়টি প্রাধান্য পায়। মুক্ত আলোচনায় বিভিন্ন নির্যাতনে ঘরবাড়ি হারানো, আপনজন হারানো পরিবারের সদস্যরা তাঁদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, নির্যাতনের পর বছরের পর বছর পার হলেও বিচার পাচ্ছেন না তাঁরা। 


মানবাধিকার প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলেন, গত বছর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নয়জন নারী হত্যার শিকার হয়েছেন। গত ১০ বছরের মধ্যে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। বছরটিতে ৫৮ জন নারী ও মেয়েশিশু যৌন বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হন। নারী নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত ৭৫ জন অপরাধীর মধ্যে ৬৪ জনই বাঙালি, চারজন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার। নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর বয়স ছিল ৩ থেকে ৭৫ বছর পর্যন্ত। গত বছর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের যে পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ বা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হয়েছে, তা-ও এর আগের বছরের তুলনায় বেশি। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে একটি অংশ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে।

আলোচনায় আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের সদস্য সাংসদ উষাতন তালুকদার বলেন, ‘ধর্ষণের শিকার দুই মারমা নারী কোন আইনের বলে পুলিশি প্রহরায় আছেন, তা কেউ জানে না। এই দুই নারীর বিষয়ে সংসদে আমিই বা কতটুকু বলতে পেরেছি? প্রশাসনের সহায়তায় জমি দখল হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থা নিরুপায়, আর আমরা অসহায়। আমরা দুরু দুরু মন নিয়ে বসবাস করছি।’

কাপেং ফাউন্ডেশন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে গত ১০ বছর ধরে এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার, নারী, শিশু ও যুবদের মানবাধিকার পরিস্থিতি, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বর্তমান অবস্থা এবং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত বছর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা ভালো ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনার পর বিচার নিশ্চিত করা বা প্রতিরোধে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল, তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা বলেন,‘ গত বছর রোমেল চাকমাকে পিটিয়ে আহত করার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। লংগদুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ৩০০ বাড়ি লুটের ঘটনা ঘটে, অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় একজন বৃদ্ধ নারী মারা যান। রাঙাপানি এলাকায় ভূমিধসের পর যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাতে জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদকে সম্পৃক্ত করা হয়নি। এটি খুবই ভয়ের ব্যাপার। সীতাকুণ্ডে ১০ শিশু হামে মারা যাওয়ার পর সরকারের বোধোদয় হয়েছে।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের একটি ধারার কারণেই তেমন কিছু করতে পারছে না বলে উল্লেখ করেন বাঞ্চিতা চাকমা। তিনি আইনটির সংশোধনীর সুপারিশ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি জটিল হয়ে গেছে। ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা যায়নি। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষেরা আরও পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। বর্তমানে পার্বত্য এলাকায় বাঙালির সংখ্যাই বেশি। রোহিঙ্গা ইস্যু পার্বত্য এলাকায় নতুন সমস্যার সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘আদিবাসীরা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। মূল কথা হলো, সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা স্বীকার করছে কি না, এসব বিষয়ে সরকার লজ্জিত হয় কি না—তাই দেখার বিষয়।’ তিনি বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনায় বিচার না হলে রাষ্ট্রের জন্য তা গভীর উদ্বেগের বিষয়।

অক্সফাম বাংলাদেশের সহায়তায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন রবীন্দ্রনাথ সরেন। অক্সফাম বাংলাদেশের কর্মসূচি পরিচালক এম বি আখতার বলেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ যেন দেশ ত্যাগ না করেন—সে আহ্বান জানিয়ে সবাইকে সংঘবদ্ধ হয়ে অধিকার আদায় করতে হবে।