চিকিৎসক না হয়েও অস্ত্রোপচার

ভুয়া চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারে প্রাণ হারানো দিনমজুর চুন্নু ব্যাপারীর স্ত্রী ও সন্তানের আহাজারি। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে।  প্রথম আলো
ভুয়া চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারে প্রাণ হারানো দিনমজুর চুন্নু ব্যাপারীর স্ত্রী ও সন্তানের আহাজারি। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে। প্রথম আলো
>
  • রাজধানীতে ভুয়া চিকিৎসা।
  • ক্রিসেন্ট হাসপাতালে দিনমজুরের মৃত্যু।
  • চিকিৎসক না হয়েও ২৩ বছর ধরে অস্ত্রোপচার।

দিনমজুর চুন্নু ব্যাপারীর আয়ে চলত পরিবার। দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন চট্টগ্রামের কোতোয়ালিতে। বাসের ধাক্কায় পা ভেঙে ভর্তি হন ঢাকার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। সেখানে ভুয়া চিকিৎসকের অস্ত্রোপচারের শিকার হয়ে তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। পরে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেলে তিনি মারা যান।

চুন্নু ব্যাপারীর মৃত্যুর আগের দিন বুধবার রাতে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ক্রিসেন্ট হাসপাতালের দুই ভুয়া চিকিৎসকসহ সাতজনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন। র‍্যাব বলেছে, চিকিৎসক না হয়েও অস্ত্রোপচার করার দায়ে হাসপাতালটির মালিক নুরুন্নবীকে পাঁচ বছর আগে এক বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তখন তাঁর মালিকানায় পরিচালিত মক্কা-মদিনা হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি আবার ওই হাসপাতালটি চালু করেন। দুই মাস আগে মেয়াদোত্তীর্ণ রক্ত ব্যবহার করার দায়ে ওই হাসপাতালটি আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম প্রথম আলোকে বলেছেন, কলেজগেট, বাবর রোড, শ্যামলী আগারগাঁও এলাকায় অন্তত ছয়টি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক নুরুন্নবী। আইন অমান্য করার দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁর তিনটি হাসপাতাল বন্ধ করে দিয়েছেন। ধুরন্ধর প্রকৃতির নুরুন্নবী বন্ধ করে দেওয়া হাসপাতাল নতুন নামে খুলে ব্যবসা করছেন। উদাহরণ দিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ২০১৫ সালে ভুয়া চিকিৎসক দিয়ে অস্ত্রোপচার করার দায়ে আগারগাঁওয়ে নুরুন্নবীর মালিকানায় পরিচালিত মরিয়ম হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেড় মাস আগে তিনি সেই হাসপাতাল মডার্ন নামে চালু করেন। ভুল অস্ত্রোপচারের অভিযোগে ক্রিসেন্ট হাসপাতালের মালিক নুরুন্নবীর বিরুদ্ধে হত্যা মামলার প্রস্তুতি চলছে।

গতকাল বিকেলে শেরেবাংলা নগরের জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিপরীত পাশে ক্রিসেন্ট হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স ভবনের সামনে গেলে হাসপাতালটির কর্মচারী পরিচয়ে এক ব্যক্তি বলেন, হাসপাতালটি পাঁচতলায়। বুধবার রাতে সেটি ভ্রাম্যমাণ আদালত বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, রোগী নিয়ে এলে বাবর রোডে বেবি কেয়ার হাসপাতালে যান। সেখানে মালিক নুরুন্নবী আছেন। তিনি বেবি কেয়ার হাসপাতালের মালিক।

আশপাশের ওষুধের দোকানিরা হাসপাতালটি বন্ধ করার খবর জেনে গেছেন। গতকাল তাঁরা বলেন, বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে হাসপাতালটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে পাঁচতলায় উঠে দেখা যায়, হাসপাতালটির ফটকে তালা ঝুলছে। আশপাশের বেসরকারি একাধিক হাসপাতালের মালিক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নুরুন্নবী উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। চিকিৎসক না হয়েও তিনি ২৩ বছর ধরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের অস্ত্রোপচার করে আসছেন।

অভিযোগের বিষয়ে ক্রিসেন্ট হাসপাতালের মালিক নুরুন্নবী গতকাল রাতে বলেন, হাসপাতালটির মালিক তিনি ও তাঁর ভাই আবুল হোসেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন। চিকিৎসকেরাই হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করেন। যাঁদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাঁরা রোগীর অস্ত্রোপচার করেন না। আর তিনিও অস্ত্রোপচার করেন না। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে রোগীরা এসেছেন, কাউকে ভাগিয়ে আনা হয়নি।

তবে র‍্যাব বলেছে, চুন্নু ব্যাপারীসহ ২২ রোগীকে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এদের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ছয় বছরের শিশু সুমাইয়া আক্তারের ভাঙা পায়ে দুই মাস আগে অস্ত্রোপচার করেন ভুয়া চিকিৎসক আবুল হাসান ও আনোয়ার। কিন্তু ওই পায়ে পচন ধরেছে। ওই দুজন চুন্নু ব্যাপারীর পায়েও অস্ত্রোপচার করেছিলেন। অষ্টম শ্রেণি পাস এই দুই ভুয়া চিকিৎসক ছয় বছর ধরে অস্ত্রোপচার করে আসছিলেন।

বুধবার রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত চুন্নু ব্যাপারীসহ ২২ জনকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠান। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে চুন্নু ব্যাপারী মারা যান।

চুন্নু ব্যাপারীর বাড়ি ভোলা সদর উপজেলার গজারিয়ায়। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন চট্টগ্রামের কোতোয়ালি উপজেলার রেয়াজউদ্দীন বাজারে। গত মঙ্গলবার ভোরে বাজারে ট্রাক থেকে কাঁচামাল নামানোর সময় একটি যাত্রীবাহী বাস চুন্নু ব্যাপারীকে ধাক্কা দেয়। এতে তাঁর বাঁ পা ভেঙে ও ফেটে যায়। তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে ওই দিন রাতেই ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়।

চুন্নু ব্যাপারীর ভাই হারুন ব্যাপারী বলেন, এক দালাল এসে বলে এখানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসক নেই, এই হাসপাতালের আরেকটি অংশ পাশেই রয়েছে। সেটির নাম ক্রিসেন্ট হাসপাতাল। ওই হাসপাতালে রোগী নেওয়ার পর তাঁদের কাছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। পরে দর-কষাকষির পর ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঠিক করা হয়। রাতে ক্রিসেন্ট হাসপাতালে কোনো চিকিৎসাই করা হয়নি। ধার করে হাসপাতালের লোকদের ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বুধবার রাতে চুন্নুকে অস্ত্রোপচারের জন্য নেওয়া হয়। এ সময় র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত আসেন।