মার্কিন নিরাপত্তা পরিকল্পনায় যেতে সময় নেবে বাংলাদেশ

লিসা কার্টিস
লিসা কার্টিস
>
  • আইপিএসে যুক্ত হতে সময় নেবে বাংলাদেশ
  • গওহর রিজভীর সঙ্গে দেখা করেন লিসা কার্টিস
  • দুশ্চিন্তা চীনকে নিয়ে
  • অস্ত্র বিক্রিতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলে (আইপিএস) বাংলাদেশ কীভাবে যুক্ত হবে, সেটা ওয়াশিংটন স্পষ্ট করেনি। তা ছাড়া আইপিএসে কীভাবে কাজ হবে, তা এখনো বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করেনি ওয়াশিংটন। তাই জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম অংশ এবং অবকাঠামো উন্নয়ন স্বচ্ছতা, সার্বভৌমত্ব, আইনের শাসনসহ বেশ কিছু মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়া যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএসে যুক্ত হতে সময় নেবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপসহকারী লিসা কার্টিসের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার ছিল আইপিএস। সব আলোচনাতেই তিনি বিষয়টি তুলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বিষয়টি নিয়ে কিছুটা সময়জুড়ে আলোচনা করেছেন। দুই আলোচনাতেই তাঁকে খুব স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেওয়া হোক। এসব দেখে বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেবে।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে তিন দিনের বাংলাদেশ সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অন্যতম জ্যেষ্ঠ পরিচালক লিসা কার্টিস মূলত রোহিঙ্গা সমস্যা, আইপিএসে বাংলাদেশকে যুক্ত করা এবং বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনের ওপর জোর দেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে আলোচনায় তিনি দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানো ও যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির প্রসঙ্গগুলো তোলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তাঁর সেই চাওয়াটি পূরণ হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে দেখা করেন লিসা কার্টিস।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টার সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় উপস্থিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লিসা কার্টিস আইপিএসে বাংলাদেশকে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানানোর সময় গত বছরের জুনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর প্রচারিত যৌথ ঘোষণার প্রসঙ্গ টানেন।

এ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ “ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলে” ট্রাম্প প্রশাসন যে বাংলাদেশকে চায়, সেটি লিসা কার্টিস বলেছেন। তবে আমরা তাঁকে বলেছি, এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে তা নিয়ে যে কারও বিস্তারিত জানাটা জরুরি। তাই যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে এই কৌশল বাস্তবায়ন করবে আর বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে আমরা জানতে চেয়েছি।’

বাংলাদেশের কূটনীতিকেরা জানান, গত জুনে প্রচারিত মোদি-ট্রাম্প যৌথ বিবৃতিতে আইপিএসে নৌ ও বিমান চলাচলের পাশাপাশি অবাধ বাণিজ্যের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে সব ধরনের আঞ্চলিক ও সামুদ্রিক বিরোধের নিষ্পত্তির কথা এতে বলা আছে। সামগ্রিকভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন ও ঋণের অর্থের দায়িত্বশীল ব্যবহারের মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা নিশ্চিত, আইনের শাসন ও পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রসঙ্গটি রয়েছে আইপিএসে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের সঙ্গে যোগসূত্র
গত বছরের মাঝামাঝি থেকে আইপিএসের কথা বেশ জোরের সঙ্গে প্রচার করছে ট্রাম্প প্রশাসন। গত ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল গৃহীত হওয়ার পর তারা এখন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরের দেশগুলোকে এতে যুক্ত করার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর বলতে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলকে ধরা হয়েছে। এই অঞ্চলটিকে যুক্তরাষ্ট্র তার ভাষায় অবাধ ও মুক্ত দেখতে আগ্রহী। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও দেশটি আর্থিক হাতিয়ারকে পুঁজি করে এই অঞ্চলে রাজনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ হাসিলে আগ্রহী। অবকাঠামোতে বিনিয়োগ আর বাণিজ্য কৌশলের মধ্যে চীনের ভূরাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে উত্তর কোরিয়াকে চীনের মদদ দেওয়া এবং জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতার প্রসঙ্গ এসেছে। উদীয়মান বিশ্বশক্তি হিসেবে ভারতের উত্থান এবং দেশটির সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সহযোগিতাকে বিবেচনায় নিয়ে ভারতের পাশাপাশি জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে এই অঞ্চলে সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের। সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ও নিরাপত্তা-এই তিন ধাপে লক্ষ্য অর্জনের পথে এগোবে যুক্তরাষ্ট্র।

আইপিএসে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ধারণা, ওই কৌশলে বড় একটি নেতিবাচক উপাদান আছে। যা হচ্ছে চীনকে আটকানো। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে এক পক্ষের লাভ হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু আমরা এটিকে দুই পক্ষের লাভ হিসেবে দেখতে চাই। যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রক্রিয়ায় আমরা কতটা সুফল পাব, সেটা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। পুরো বিষয়টিকে দেখতে হবে সহযোগিতার প্রেক্ষাপট থেকে। প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নয়। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো, তাই সমদূরবর্তী অবস্থানে থেকে অপেক্ষা করার নীতিই গ্রহণ করা উচিত।’

দুশ্চিন্তা চীনকে নিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পর্যালোচনার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সরব উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে যে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বিপুল বিনিয়োগ ট্রাম্পের দুশ্চিন্তা আরও বাড়িয়েছে। কাজেই এই অঞ্চলে চীনকে প্রতিরোধের নতুন কর্মকৌশল যে আইপিএস, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে চীন বিপুল অর্থ নিয়ে যেভাবে এগিয়ে আসছে, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অস্বস্তির বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র তুলেছে। বাংলাদেশ অবশ্য স্পষ্ট করেই বলেছে, উন্নয়নের যাত্রায় যে দেশ সঙ্গী হবে, সেই দেশকেই নেবে বাংলাদেশ। তবে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিকে নিয়ে এ প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে, তাই সবকিছু বুঝেই আইপিএসে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে অন্য দেশগুলো এতে কীভাবে থাকবে, সেটিও বাংলাদেশ দেখতে চায় বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।

অস্ত্র বিক্রিতে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র
গত এক দশকে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা নিবিড় করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে ঢাকা সফরের সময় লিসা কার্টিস তাঁর সন্তুষ্টির কথা জানান। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সঙ্গে আলোচনায় তিনি প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। কৌশলগত ভারসাম্য আনার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র কেনার প্রসঙ্গ টানেন লিসা কার্টিস।

আরও দ্রুততার সঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের লক্ষ্যে তথ্য আদান-প্রদানের পরিধি বাড়ানোর প্রসঙ্গ টানেন লিসা কার্টিস। এখন দুই দেশ সুনির্দিষ্ট ব্যক্তি, কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে একে অন্যকে সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু বিষয়টি যদি এমন হয়, এক দেশ অন্য দেশের সন্দেহভাজনদের বিস্তারিত তালিকা বিনিময় করবে, তখন সহিংসতা ঘটার আগেই তা দমন করা যাবে। এ নিয়ে বাংলাদেশের যুক্তি হচ্ছে একটি সমন্বিত আইনি প্রক্রিয়া কিংবা চুক্তির আওতায় এটা হতে পারে। তা না হলে এটা সম্ভব নয়।

লিসা কার্টিস তাঁর আলোচনায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের অভিযানে সামরিক বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্য উন্নততর প্রশিক্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামর্থ্য বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা চেয়েছেন।

আইপিএসে বাংলাদেশের যুক্ততা নিয়ে জানতে চাইলে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে কৌশলের কথা বলছে, তাতে আরও স্বচ্ছতা থাকা বাঞ্ছনীয়। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই সবার সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু কোনো উদ্যোগে যুক্ত হয়ে যাতে কারও বিরুদ্ধে না যাই, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা উচিত। সমুদ্রপথে সহযোগিতার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আসছে, অবস্থানগত সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে এর সুফল পাওয়া উচিত। এটি করতে হলে আমাদের উদ্যোগী হয়ে নীতিগত অবস্থান ঠিক করতে হবে।