'লিভার ফেইলিয়র' চিকিৎসায় দেশীয় চিকিৎসকদের সাফল্য

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষক দল: (ডান থেকে বামে) এমডি রেসিডেন্ট শেখ আনিসুল হক, লিভার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসাদুল ইসলাম ও হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নূর এ আলম। ছবি: প্রথম আলো
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষক দল: (ডান থেকে বামে) এমডি রেসিডেন্ট শেখ আনিসুল হক, লিভার বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসাদুল ইসলাম ও হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নূর এ আলম। ছবি: প্রথম আলো

হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের সর্বাধিক কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার ও ৯০ ভাগ অকার্যকর লিভার চিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্য পেয়েছেন বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা। ‘স্টেম সেল থেরাপি’ নামে এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশের একদল লিভার বিশেষজ্ঞ। এ চিকিৎসায় প্রায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া স্বল্প খরচে লিভার থেকে বিলিরুবিন কমানোর পদ্ধতিও আবিষ্কার করেছে এই উদ্ভাবক দল। ‘বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস’ যে পদ্ধতিতে করা হয়েছে, তা এর আগে বিশ্বের কোথাও করা হয়নি বলে জানালেন ওই চিকিৎসকেরা।

বিএসএমএমইউর লিভার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান অধ্যাপক মামুন আল মাহতাবের নেতৃত্বে একদল তরুণ গবেষক এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই গবেষক দলে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসাদুল ইসলাম, এমডি রেসিডেন্ট শেখ আনিসুল হক ও আশরাফুল হক। এ ছাড়া এ গবেষণায় যুক্ত আছেন হেপাটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নূর এ আলম।

ভাইরাল হেপাটাইটিস কিংবা লিভার সিরোসিসের মতো ক্রনিক ব্যাধিতে বেশির ভাগ সময় লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যায়। অর্থাৎ এ দুই ধরনের রোগের ক্ষেত্রেই রোগীর লিভার ফেইলিয়র দেখা দিতে পারে।

লিভার ফেইলিয়রের চিকিৎসা হিসেবে প্রথমেই বলা হয় ‘লিভার ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের’ কথা। তবে লিভার ট্রান্সপ্ল্যানটেশন অত্যন্ত জটিল একটি চিকিৎসা। ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের ক্ষেত্রে ডোনার হতে হয় আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কাউকে, যা জোগাড় করা সব সময় সম্ভব হয় না। আবার অ্যাকিউট লিভার ফেইলিয়রের ক্ষেত্রে সময়ও পাওয়া যায় খুব কম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকেরা জানালেন, দেশে এই মুহূর্তে লিভার ট্রান্সপ্ল্যানটেশনের সুবিধা নেই। ভারতে এই চিকিৎসা হয়, তবে তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এসব বিষয় মাথায় রেখে গবেষক দলের লিভার ফেইলিয়রের চিকিৎসায় একদমই নতুন চিন্তা ‘স্টেম সেল থেরাপি’।

ওই গবেষক দলই ‘বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস’ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। দীর্ঘদিন ধরে জন্ডিসে আক্রান্ত, রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা অস্বাভাবিক অথবা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তি, যাঁর বিলিরুবিন না কমায় কেমোথেরাপি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না—এমন রোগীদের চিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্য হলো ‘বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস’। এ পদ্ধতিতে স্বল্প ব্যয়ে লিভার থেকে বিলিরুবিন বের করে আনা সম্ভব।

‘স্টেম সেল থেরাপি’ কী?

ডা. মামুন আল মাহতাব জানালেন, ‘কয়েক বছর ধরে ক্রনিক ও অ্যাকিউট অন ক্রনিক লিভার ফেইলিয়রের রোগীদের “গ্র্যানুলোসাইট কলোনি স্টিমুলেটিং ফ্যাক্টর” (জিসিএসএফ) ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জিসিএসএফ এমন একটি ওষুধ, যা ব্যবহার করা হলে রক্তে স্টেম সেলের সংখ্যা বহু গুণে বেড়ে যায়। এই স্টেম সেল থেরাপির দুটি অংশ রয়েছে যার প্রথম অংশে স্টেম সেল সংগ্রহ করা হয়। কাজটি করে ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগ। এর পরের কাজ হচ্ছে এটাকে টার্গেট অর্গানে প্রবেশ করানো যা কাজটি করে হেপাটোলজি বিভাগ। স্টেম সেলগুলোই প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমে টার্গেট অর্গানে পৌঁছে এটির রিজেনারেশনে সাহায্য করে। এরপর আমরা ক্যাথ ল্যাবে এনজিওগ্রামের মাধ্যমে ওই স্টেম সেলগুলো সরাসরি হেপাটিক আর্টারি দিয়ে লিভারে প্রবেশ করায়।’

কার্যক্রমটির সঙ্গে যুক্ত অন্যতম গবেষক ড. শেখ আনিসুল হক বলেন, ‘জিসিএসএফ ব্যবহার করে লিভার ফেইলিয়রের চিকিৎসা খুব পরিচিত নয়। তবে একদম নতুনও নয়। ভারতের কয়েকটি জায়গায় এভাবে চিকিৎসা করা হয়। তবে ভারতের থেকে আমরা এক ধাপ এগিয়ে আছি। আমরা জিসিএসএফ প্রয়োগ করে রক্ত থেকে বেড়ে যাওয়া স্টেম সেলগুলোকে বিশেষ পদ্ধতিতে আলাদা করে নিই। অনেকটা ছেঁকে নেওয়ার মতো। এ থেরাপিতে আমাদের সাফল্যের হার ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে আমরা লিভার কার্যকর করতে সক্ষম হয়েছি।’

‘বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস’ পদ্ধতি কী?

বিশেষ এই পদ্ধতির মাধ্যমে লিভার থেকে বিলিরুবিন বের করে আনতে কিডনি হিমোডায়ালাইসিসের মতো বিশেষ মেশিনে বিশেষ কিট ব্যবহার করা হয়। বিশেষ কিটের ছাঁকনির ভেতর দিয়ে রোগীর রক্ত প্রবাহিত করে প্লাজমা থেকে বিলিরুবিন আলাদা করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবেই জন্ডিসে আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। এর আগে বিশ্বের কোথাও লিভার বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস এই পদ্ধতিতে করা হয়নি বলে জানালেন গবেষকেরা। এতে খরচও পড়ে অনেক কম।

গত মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো একজন রোগীর ‘লিভার বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস’ করা হয়। অধ্যাপক মামুন আল মাহতাব বলেন, ‘আমাদের বেশ কয়েকজন রোগী আছেন যাঁরা লিভারের বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন। বিশেষ করে লিভার সিরোসিস। ই-ভাইরাস, সি-ভাইরাস ও ফ্যাটি লিভারজনিত সমস্যার কারণে লিভার ফেইলিয়র হয়ে থাকে। এর ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায় যেমন পেটে পানি আসে, রক্ত বমি, জন্ডিস। এতে দেখা যায় পেটে পানি আসা বা রক্ত বমি আমরা কমাতে পারি। কিন্তু জন্ডিস কমানোর কোনো ওষুধ নেই। এ ক্ষেত্রে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রয়োজন হয়। তবে বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস উদ্ভাবনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক জন্ডিস কমানো সম্ভব হবে।’

এ প্রসঙ্গে ডা. আনিসুল হক বলেন, ‘প্রমিথিওস ও মার্স এ দুই ধরনের ডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে উন্নত বিশ্বে লিভার ডায়ালাইসিস করা হয়। এগুলো খুবই ব্যয়বহুল। একবার একজন রোগীর ডায়ালাইসিস করতে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের বারডেম হাসপাতালে এমন একটি মেশিন আছে। তবে এসব মেশিনে সাধারণত প্রচুর এলবুমিন ব্যবহার করে ডায়ালাইসিস করা হয়। তবে আমরা এফেরেসিস (Apheresis) মেশিন ব্যবহার করে কোনো এলবুমিন ব্যবহার না করেই লিভার থেকে বিলিরুবিন ডায়ালাইসিস পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছি। এই পদ্ধতিতে একবার লিভার ডায়ালাইসিস করতে খরচ পড়ে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। এলবুমিন ব্যবহার অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এ ছাড়া ডায়ালাইসিসের সময় রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমরাই প্রথম এফেরেসিস মেশিন ব্যবহার করি। দেখা গেছে এটির ব্যবহারে ব্যয় কমে আসছে সেই সঙ্গে সফলতার হারও ভালো।’

গবেষকেরা জানালেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ লিভার ফেইলিয়রে মারা যায়। আশা করা যায়, স্টেম সেল থেরাপি ও বিলিরুবিন ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অনেক অসহায় রোগীকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা সক্ষম হবে।