বছরে ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে

২০১২ সালে ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ।  ২০৩২ সালে তা কমিয়ে ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।  অথচ এখন ব্যয় হচ্ছে ৬৭ শতাংশ
২০১২ সালে ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ। ২০৩২ সালে তা কমিয়ে ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অথচ এখন ব্যয় হচ্ছে ৬৭ শতাংশ
>
  • ২০১২ সালে ব্যক্তির ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ।
  • ২০৩২ সালে তা কমিয়ে ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
  • অথচ এখন ব্যয় হচ্ছে ৬৭ শতাংশ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশে প্রতিবছর সাড়ে ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। আর বড় ধরনের আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে সোয়া দুই কোটি মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসকে সামনে রেখে পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৪ এপ্রিল এই তথ্য প্রকাশ করেছে।

আজ শনিবার বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। দিনটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা: সবার জন্য, সর্বত্র’। জাতিসংঘের এই বিশেষায়িত সংস্থাটি বলছে, স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব অংশ বেশি হলে তা সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ) এখন অন্যতম প্রধান বৈশ্বিক স্বাস্থ্য অ্যাজেন্ডা। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার মূল কথা হচ্ছে: প্রতিটি মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন সেবা পাবে, সেবা নিতে গিয়ে সে আর্থিক অনটনে পড়বে না বা নিঃস্ব হবে না। আর সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকবে না।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও কাগজে-কলমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে নিয়েছে। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি, চলমান স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত উন্নয়ন কর্মসূচি দলিলে এর উল্লেখ আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাগজে ও বাস্তব পরিস্থিতিতে ব্যাপক ফারাক রয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির ব্যয় কমানোর উদ্যোগের কথা বলেছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘হেলথ ইকোনমিকস ইউনিট’ ২০১২ সালে স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র (২০১২-৩২) তৈরি করে। এর উদ্দেশ্য ছিল সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে অর্থায়ন কৌশল ঠিক করা। তাতে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য খাতে ধীরে ধীরে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমাতে হবে। ২০১২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ। ২০৩২ সালে তা কমিয়ে ৩২ শতাংশ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বাস্তব পরিস্থিতি হয়েছে ভিন্ন। ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমেনি। সরকারি হিসাব বলছে, বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতের মোট ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে বহন করে। অর্থাৎ নিজের পকেট থেকে খরচ আরও বেড়েছে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে মানুষ সবচেয়ে (প্রায় ৭০ শতাংশ) বেশি খরচ করে ওষুধের পেছনে। ওষুধের দামের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বেসরকারি খাতে যন্ত্রপাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বেসরকারি বিশেষায়িত সেবার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার জন্য মানুষের পকেট থেকে বেশি খরচ হচ্ছে। ভবিষ্যতে ব্যয় আরও বাড়বে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার ক্ষেত্রে আর্থিক নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিঃস্বায়ন বা দরিদ্র হয়ে পড়া ও আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়-এই দুটি বিষয় দিয়ে আর্থিক নিরাপত্তা পরিমাপ করা হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশের ৩ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ বা সাড়ে ৫২ লাখ মানুষ প্রতিবছর নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে শুধু চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে। অন্যদিকে পারিবারিক ব্যয়ের ১০ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্য ব্যয়ই হচ্ছে আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়। বাংলাদেশের ১৪ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ প্রতিবছর এর মুখোমুখি হচ্ছে। এদের মোট সংখ্যা ২ কোটি ২৪ লাখ।

আছে বৈষম্য
স্বাস্থ্যে বৈষম্যের বিষয়টি বাংলাদেশে খুব বেশি আলোচনা হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে তা হতে হবে বৈষম্যমুক্ত, কাউকে পেছনে রাখা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা বৈষম্য আছে। বৈষম্য আছে শহরে ও নগরে, আছে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণিতে। প্রতিবেদনে এর কিছু উদাহরণও তুলে ধরেছে সংস্থাটি।

শহরের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা গ্রামের মানুষের চেয়ে বেশি পাচ্ছে। শহরের ৬০ শতাংশের বেশি প্রসূতি প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পান। আর গ্রামের প্রসূতিদের ক্ষেত্রে এই হার ৪০ শতাংশের নিচে। শহরের প্রায় ৮০ শতাংশ মা প্রসবের দুই দিনের মধ্যে প্রসবোত্তর সেবা পান, গ্রামে তা ৬০ শতাংশের কম। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে শহরের শিশুদের তুলনায় গ্রামের শিশুদের চিকিৎসকের কাছে কম নেওয়া হয়।

শহর-গ্রাম যেখানেই হোক, দরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে। ধনিক শ্রেণির প্রায় ৮০ শতাংশ প্রসূতি প্রসবের সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান। দরিদ্র প্রসূতিদের ২০ শতাংশের কম দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সেবা পান। ধনিক শ্রেণির ৮০ শতাংশের বেশি মা প্রসবের দুই দিনের মধ্যে প্রসবোত্তর সেবা পান, দরিদ্র শ্রেণিতে তা ৪০ শতাংশের কিছু বেশি। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ধনিক শ্রেণির ৪০ শতাংশ শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়, দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে এই হার ২০ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সেবাদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য পরিমাপের কোনো কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বাংলাদেশে নেই। কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় তা দরকার।

আজ বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস
৭০ বছর আগে ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার দিনটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি সরকারিভাবে পালিত হবে। আজ সকালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এ ছাড়া জেলা পর্যায়ে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা হবে। একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও সভা-সেমিনার আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে।