বাড়ি দখলে কাউন্সিলরের পাঁয়তারা!

পশ্চিম শেওড়াপাড়ার পীরেরবাগ রোডের বাঁ পাশের এই জায়গার মালিক ডিএনসিসির এক কাউন্সিলর ও তাঁর ভাইয়েরা। যতবারই এই রাস্তাটি চওড়া করা হয়েছে, ততবারই ডান পাশের বাড়িটি ভেঙে জায়গা নেওয়া হয়েছে।  ছবি: প্রথম আলো
পশ্চিম শেওড়াপাড়ার পীরেরবাগ রোডের বাঁ পাশের এই জায়গার মালিক ডিএনসিসির এক কাউন্সিলর ও তাঁর ভাইয়েরা। যতবারই এই রাস্তাটি চওড়া করা হয়েছে, ততবারই ডান পাশের বাড়িটি ভেঙে জায়গা নেওয়া হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য জমি নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন না থাকলেও ভেঙে দেওয়া হয়েছে পুরো বাড়ি। তারপর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বাড়ির পয়োনিষ্কাশনের লাইন। এখন চলছে বাকি জমি দখলের পাঁয়তারা।

পশ্চিম শেওড়াপাড়ার পীরেরবাগ সড়কে এক নারীর জমি নিয়ে চলছে এই তুঘলকি কাণ্ড। কিন্তু রাস্তার অপর পাশে স্থানীয় কাউন্সিলরের জমি থাকলেও রাস্তা বাড়াতে সেখান থেকে জমি নেওয়া হয়নি। কিন্তু বাকি রাস্তায় দুপাশ থেকেই জায়গা নেওয়া হয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কাউন্সিলর এখন তাঁদের পুরো জায়গাটিই দখল করতে চাইছেন।

রোকেয়া সরণি থেকে ৬০ ফুট সড়ক পর্যন্ত পীরেরবাগের রাস্তা প্রশস্ত করা হয় ২০১৭ সালে জানুয়ারির দিকে। এতে সড়কের দুই পাশের বাড়িগুলোর সামনের অংশ ভাঙা পড়ে। কিন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ ও তাঁর ভাইদের জায়গার সামনে এসে রাস্তাটি বেঁকে যায়। কারণ, পুরো জমি নেওয়া হয় তাঁদের উল্টা পাশের বাড়ি থেকে। ওই বাড়ির মালিক জাহান আরা বেগম।

জাহান আরা বেগমের বাড়ির হোল্ডিং নম্বর ৩৭০/১। ২৪ শতাংশ আয়তনের এই বাড়ি রাস্তা বরাবর প্রায় ২৫০ ফুট লম্বা। বাড়ির মালিকের অভিযোগ, রাস্তা বাড়ানোর নামে তাঁর বাড়ির প্রায় ৮ শতক জায়গা নেওয়া হয়েছে। এর জন্য সামনের দোকান ও সীমানাপ্রাচীর ভাঙাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু কমিশনারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর একতলা বাসাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় সিটি করপোরেশন। তারপর বাড়ির পয়োনিষ্কাশনের সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন জায়গাটি অবৈধভাবে দখল করার পাঁয়তারা করছেন কাউন্সিলর।

বিষয়টি স্থানীয় সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার, ডিএনসিসি প্যানেল মেয়র ওসমান গনি, ঢাকা জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়। কিন্তু কেউ বাড়ির মালিককে সহযোগিতা করেননি।

১৯৬২ সালের দিকে পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ওই ২৪ শতক জায়গাটি কেনেন জাহান আরা বেগম ও তাঁর বোন হোসনে আরা বেগম (মৃত)। তখন এই এলাকাটি ধানি জমি ছিল। এই জমির উত্তর পাশের জমি ছিল ডিএনসিসির বর্তমান কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদের বাবা অলি মিয়ার। ১৯৮০ সালে এখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তখনো অলি মিয়ার জমি ছেড়ে এই দুই নারীর জমির ওপর দিয়ে প্রায় ১২ ফুট চওড়া রাস্তা তৈরি করা হয়। রাস্তা মাটিও নেওয়া হয় এই জমি থেকে। এখন রাস্তাটির প্রস্থ ২৪ ফুট। যতবারই রাস্তা বাড়ানো হয়েছে, ততবারই এই বাড়ি থেকে জায়গা নেওয়া হয়েছে। উল্টো পাশে কাউন্সিলরদের কাছ থেকে কোনো জায়গা নেওয়া হয়নি।

বাড়ির মালিক জাহান আরা বেগম বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পূর্ব ও পশ্চিম অংশে বাড়িগুলো তিন থেকে ছয় ফিট রাস্তার ভেতর। তারপরও কাউন্সিলরের নির্দেশে গত ২০১৭ সালে বিনা নোটিশে আমার বাড়ির মূল অংশ ভেঙে ফেলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও ডিএনসিসি। তাদের দাবি ছিল, আমাদের বাড়ির নকশা রাজউকে নেই। আমরা বাড়িটি তৈরি করেছিলাম ১৯৮৭ সালে। বিষয়টি রাজউক, ডিএনসিসিকে লিখিতভাবে জানানো হলেও তারা তদন্তে আসেনি। এর মধ্যে গত জানুয়ারিতে পরিকল্পিতভাবে আমার বাড়ির পয়োনিষ্কাশন লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ভাড়াটেরা বাড়ি ছেড়ে চলে যান।’ তিনি বলেন, ‘গত ১৯ মার্চ পয়োনিষ্কাশনের সংযোগ চালু করতে কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে এলাকায় গিয়েছিলাম। কিন্তু কাউন্সিলরের পক্ষের যুবলীগ কর্মী কবির আহম্মেদ কাজে বাধা দেন। শ্রমিকেরা ভয়ে চলে যান। এভাবে একের পর এক অত্যাচার করে আমাকে উৎখাত করতে চাইছে। অথচ এই এলাকায় ১ শতক জমির দাম কোটি টাকার বেশি।’

সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পীরেরবাগ রোডের ৩৫১/৪ থেকে ৩৬৫/১২ নম্বর হোল্ডিং পর্যন্ত রাস্তাটি বাঁকা। এই বাঁকের দুই-তৃতীয়াংশই জাহান আরা বেগমের জায়গার মধ্যে পড়েছে। তাঁর বাড়িটি ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে। পয়োবর্জ্যের দুর্গন্ধ বাতাসে চারদিকে ছড়াচ্ছে। অন্যদিকে রাস্তার উত্তর পাশে টিনশেডের দোকান ও কাঁচাবাজার দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন কাউন্সিলর ও তাঁর চাচাতো ভাইয়েরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় দুই বাড়ির মালিক বলেন, পীরেরবাগ সড়ক প্রশস্ত করার সময় কাউন্সিলর কারও বাড়ি ভাঙছেন, আবার মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে কারোরটি ভাঙেনি। এতে রোডটি একেক জায়গায় একেক রকম প্রশস্ত বা আঁকাবাঁকা হয়েছে। এসব অনিয়ম নিয়ে মহল্লার কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না।

জানতে চাইলে ডিএনসিসির অঞ্চল-৪-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোল্লাহ মোহাম্মদ নূরুজ্জমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যমান রাস্তাটি আমরা প্রশস্ত করেছি। এ ক্ষেত্রে সড়কের দুপাশেই যতটুকু জায়গা দরকার, নিয়েছি। তা তদারক করেছেন স্থানীয় কাউন্সিলর। এ নিয়ে জাহান আরা বেগমের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছে বা আছে। তবে কেউ জায়গা না দিতে চাইলে আমরা জোর করে নিতে পারি না। এখনো যদি ওই নারী যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জায়গা মেপে ফেরত চান, আমরা তাঁকে তা ফিরিয়ে দিতে সহযোগিতা করব।’

কিন্তু ভুক্তভোগী জাহান আরা বেগম অভিযোগ করেন, তিনি কয়েক দিন আগে নির্বাহী প্রকৌশলী মোল্লাহ মোহাম্মদ নূরুজ্জমানের কাছে প্রতিকারের জন্য গিয়েছেন। নূরুজ্জমান তাঁকে কাউন্সিলরের কাছে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সব অভিযোগ অস্বীকার করেন কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাস্তাটি ৩০ ফুট প্রশস্ত করতে যেখানে যতটুকু জায়গা দরকার, সে অনুযায়ীই নিয়েছি। কিন্তু ওই বাড়ির মালিক রাস্তার জন্য জায়গা ছাড়তে চাননি। তাই রাজউকের মাধ্যমে তাঁর বাড়িটি ভাঙা হয়েছে।’

রাস্তার জন্য ভবনের ভেতর থেকে কি জায়গা নিতে হয়েছে, না হলে ভবনটি কেন ভাঙা হলো—এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি কাউন্সিলর। তিনি শুধু বলেন, ‘রাস্তার জন্য যতটুকু জায়গা দরকার ছিল, নিয়েছি।’

ওয়াসার কাছে তিন শতক

জাহান আরা বেগম জানান, ১৯৯৯ সালে রেজিস্ট্রিহীন একটি চুক্তিপত্রের মাধ্যমে তার ৩ শতকের বেশি জায়গায় বিনা ভাড়ায় ও বিনা মূল্যে পানির পাম্প বসায় ঢাকা ওয়াসা। এই চুক্তিতে শর্ত ছিল মালিক জায়গা ফেরত চাইলে তা ফিরিয়ে দিতে ওয়াসা বাধ্য থাকবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিজের প্রয়োজনে জায়গাটি ফেরত চাইলে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে ওয়াসা। বিষয়টি ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকা জেলা প্রশাসক এবং এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাঁকে কেউ সহযোগিতা করছে না। প্রতিটি কাজে কাউন্সিলর নিজে গিয়ে বাধা দিচ্ছেন।

গত বছরের ২ মার্চ জায়গাটি ফেরত চেয়ে ওয়াসার কাছে আবেদন করেছিলেন জাহান আরা বেগম। এর ২৬ দিন পর ওয়াসার ভূমি বিভাগের উপসচিব শামীম নাজিবা স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ওই জায়গা ফেরত দেওয়া যাবে না বলে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু এই জায়গার ভাড়া বা মূল্য দেওয়া হবে কি না, চিঠিতে কিছুই বলা হয়নি।

জাহান আরা বেগম বলেন, আগে এই এলাকায় তীব্র পানিসংকট ছিল। মানবিক কারণে জায়গাটি ওয়াসাকে দিয়ে আজ তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান।