দিন গড়াচ্ছে, ঝুঁকি বাড়ছে

>
  • বন্যা-ভূমিধসের ঝুঁকিতে ১ লাখ ৩৩ হাজার রোহিঙ্গা।
  • জুনে ভাসানচরে স্থানান্তর।
  • যাচাইয়ের নামে প্রত্যাবাসন বিলম্ব করছে মিয়ানমার।

সময় যত গড়াচ্ছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় দুর্যোগের ঝুঁকিও তত বাড়ছে। কারণ, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মৌসুম শুরু হয়েছে। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি রয়েছে। একই সঙ্গে নিজ দেশ মিয়ানমারে তাদের ফেরাও বিলম্বিত হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকিতে থাকা কক্সবাজারের প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখকে জুনের মধ্যে নোয়াখালীর হাতিয়ায় ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। আর ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে উখিয়ার আরেকটি ‘নিরাপদ পাহাড়ে’ সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে।

গতকাল শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচারমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়াকে (আরএফএ) মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী উইন মায়াত আইয়ের দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রসঙ্গ উঠে আসে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আলোচনা করতে ১১-১২ এপ্রিল বাংলাদেশ সফর করার কথা রয়েছে উইন মায়াতের।

সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারের মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, সে অনুযায়ী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগোলে এবং শরণার্থীরা চুক্তি মোতাবেক ফরমগুলো পূরণ করলে এটি বিলম্বিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী তা সেভাবে হয়নি।’ বাংলাদেশ সফরে তাঁরা এ নিয়ে কথা বলবেন।

গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের পাঠানো ৮ হাজার ৩২ জনের একটি তালিকা থেকে মিয়ানমার মাত্র কয়েক শ জনকে প্রত্যাবাসনের জন্য যোগ্য বলে জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাকিদের কী হবে-এমন প্রশ্নে উইন মায়াত বলেন, ‘আমি আগেই বলেছি, চুক্তির নির্দেশনা অনুযায়ী তারা ফরম পূরণ করেনি। এ কারণে রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাইয়ে আরও সময় প্রয়োজন। যাদের যাচাই করতে পেরেছি তাদের একটা তালিকা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি।’

মিয়ানমারের এমন অজুহাত নতুন নয়। গত বছরের ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি হয়। ১৯ ডিসেম্বর গঠিত হয় ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি)। এরপর তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে আসছে।

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে সাড়ে ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে।

ঝুঁকির মুখে আশ্রয় শিবির
চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা শিবিরের অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, কক্সবাজারে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ৮০ হাজার বন্যা ও ২৩ হাজার ভূমিধসের মারাত্মক ঝুঁকিতে আছে। মাঝারি ঝুঁকিতে আছে আরও ১ লাখ রোহিঙ্গা।

ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে ১৯৭৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, মে মাসে কক্সবাজার জেলায় গড়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। জুনে তা বেড়ে ৮০০ এবং জুলাই মাসে তা ১০০০ মিলিমিটার হয়। এপ্রিল ও মে মাসে নিয়মিতভাবে সেখানে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে।

ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় বলছে, তারা উখিয়ার কুতুপালং থেকে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার রোহিঙ্গাকে পার্শ্ববর্তী একটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পেরেছে। বাকি আরও ১৫ হাজারকে মে মাসের মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হবে। জুনের প্রথম সপ্তাহে টেকনাফ থেকে সরাসরি জাহাজে করে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়া শুরু হবে। আর বাকিদের নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করা হবে।

এ ব্যাপারে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ভাসানচরে রোহিঙ্গা শিবির নির্মাণের কাজ ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী জুনের আগে বাকি কাজ শেষ হবে। ফলে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তাদের ওই চরে নেওয়ার কাজ শুরু হবে। বর্ষা পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই তাদের ওই নিরাপদ এলাকায় সরিয়ে নেওয়া যাবে।

ঝুঁকিপূর্ণদের ৫৪ শতাংশ শিশু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের করা ‘বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরের বন্যা ও ভূমিধসের প্রভাব বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১ লাখ ২ হাজার ৩৩ জন রোহিঙ্গাকে মে-জুনের মধ্যে নিরাপদ স্থানে সরাতে না পারলে সেখানে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবস্থান করা রোহিঙ্গাদের ৫৪ শতাংশই হচ্ছে শিশু এবং ৪ শতাংশ বয়স্ক। বন্যা ও ভূমিধসের সময় তারা সবচেয়ে বেশি বিপদের মুখে থাকবে। এসব মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

সমীক্ষায় নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদের ডিন এ এস এম মাকসুদ কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে যত ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, তার বেশির ভাগই টেকনাফ ও উখিয়ায় আঘাত হানে। এর সঙ্গে সেখানে বনভূমি বিনষ্ট, ভূমিরূপের প্রাকৃতিক গঠন ও বুনন নষ্ট করে ফেলায় ওই ঝুঁকি আরও বেড়ে গেছে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় থাকা রোহিঙ্গাদের ওই শিবিরগুলো থেকে সরিয়ে নিতে হবে।

কক্সবাজার জেলার ভূমিরূপ ও পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করে এমন সংস্থাগুলো বলছে, রোহিঙ্গা শিবির গড়ে ওঠার আগে সেখানে বনভূমি ছিল। ফলে অতিবৃষ্টির কবল থেকে বৃক্ষ-লতাগুল্ম ওই মাটিকে ধসের কবল থেকে রক্ষা করত। কিন্তু শিবির গড়ে তোলার জন্য নিয়মিতভাবে ওই গাছ কাটা হচ্ছে। ফলে ওই স্থানগুলোর মাটি আলগা হয়ে ধসের জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গা শিবিরের পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে আরেকটি সমীক্ষা করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরা বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হেনেছিল। রোহিঙ্গা শিবির যে এলাকায় গড়ে উঠেছে, সেখানেও ওই ‘মোরা’র প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস ও ঝড় বয়ে যায়। এমন ঝড় এ বছর আঘাত হানলে আশ্রয় নেওয়া ৭০ শতাংশ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত সম্প্রতি কুতুপালং এলাকায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। তাঁর মতে, কুতুপালং শিবিরে বসবাস করা বেশির ভাগ রোহিঙ্গা দুর্যোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। পাহাড় কেটে বসতি গড়া রোহিঙ্গাদের বড় অংশ পাহাড়ধসের মুখে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৫ থেকে ২০ হাজার রোহিঙ্গা খালের দুই পাশের এলাকায় অবস্থান করছে। হঠাৎ বন্যা বা পাহাড়ি ঢল নামলে এদের বড় অংশ মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। এ ছাড়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার মলমূত্র পাহাড়ের বিভিন্ন অংশে জমা হচ্ছে, বৃষ্টি হলে তা পুরো এলাকায় একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে। এতে পুরো এলাকায় বিভিন্ন রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে। তাই সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকার দিয়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা এবং তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ একযোগে চালাতে হবে।