হাওরে সোনালি ধানে কৃষকের হাসি

কিশোরগঞ্জে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের গোবদিঘি হাওরে।  প্রথম আলো
কিশোরগঞ্জে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতিমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের গোবদিঘি হাওরে। প্রথম আলো

গেল বছর কৃষক বাক্কার মিয়া নিজের শেষ সম্বল গরু-বাছুর বিক্রি ও ধারদেনা করে দুই একর জমিতে বোরো ধান আবাদ করেছিলেন। কিন্তু অকালবন্যা কেড়ে নিয়েছিল তাঁর মুখের হাসি। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এক ছটাক ধানও তিনি ঘরে তুলতে পারেননি। তারপরও হাল ছাড়েননি বাক্কার। ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় এবারও তিনি ঋণ করে একই জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। দুই দিন ধরে সেই ধান কাটাও শুরু করেছেন তিনি। হাসি ফুটেছে তাঁর মুখে। 

কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার গোবদিঘি গ্রামের বাক্কার মিয়াই শুধু নন, বোরো ধানের ভালো ফলন হওয়ায় হাসির ঝলক দেখা দিয়েছে হাওরাঞ্চলের শত শত কৃষকের মুখে। গত বছরের অকালবন্যার ক্ষতি ও দুঃখ-কষ্ট ছাপিয়ে বুকভরা আশায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা। হাওরাঞ্চলের একমাত্র ফসল সোনালি ধান কাটাও শুরু হয়ে গেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকেরা। এখন এই ধানের ন্যায্য দাম পেলেই কেবল হাসি বজায় থাকবে কৃষকের মুখে।
কৃষক বাক্কারের জমিতে দৈনিক ৭০০ টাকা মজুরিতে ধান কাটছেন আরজু মিয়া। গত বছর তিনি কৃষক থাকলেও এবার শ্রমিক। আরজু বলেন, গেল বছর ঋণ করে তিনি তিন একর জমিতে বোরো ধান করেছিলেন। কিন্তু বন্যায় পানির নিচে তাঁর সব স্বপ্ন তলিয়ে যায়। সেই থেকে ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। বিভিন্ন কাজ করে কিছু ঋণ পরিশোধ করতে পারলেও এখনো তাঁর ৩৫ হাজার টাকার ঋণ আছে। ঋণ পরিশোধ করতে তিনি অন্যের জমিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। নিজে ধান করতে না পারলেও অন্যের জমির বাম্পার ফলন দেখে খুশি আরজু।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, এবার জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার ২৮২ হেক্টর। আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৮ মেট্রিক টন চাল।
গত বছর জেলার ১৩ উপজেলায় ১ লাখ ৫০ হাজার ৫৩৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। উজান থেকে নেমে আসা ঢল, অতিবৃষ্টি, নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি ও জলাবদ্ধতায় প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এতে জেলার ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৮১ কৃষক ৮৬৪ কোটি ২৪ লাখ ২৮ হাজার ৪০০ টাকা ক্ষতির শিকার হন। এবার ধান তুলে তাঁরা ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষায় আছেন। তবে ধান গোলায় না ওঠা পর্যন্ত বৃষ্টি আর আকাশে কালো মেঘ দেখলেই আতঙ্কের ছাপ পড়ে কৃষকদের মুখে।

কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের গোবদিঘি হাওর থেকে ধান নিয়ে ফিরছেন কয়েকজন কৃষক। প্রথম আলো
কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের গোবদিঘি হাওর থেকে ধান নিয়ে ফিরছেন কয়েকজন কৃষক। প্রথম আলো

গত মঙ্গলবার সরেজমিনে মিঠামইনের বিভিন্ন হাওরে দেখা যায়, পাকা সোনালি ধানে ভরপুর হাওরাঞ্চল। অনেকেই দুই-তিন ধরে অল্প অল্প করে কাটছেন। অন্যরা গত বছরের দুঃখ-কষ্ট ছাপিয়ে সোনালি ফসল ঘরে তোলার অপেক্ষায় আছেন। উপজেলার গোবদিঘি হাওরে কৃষক আবদুর রশিদকে আটজন শ্রমিক নিয়ে ধান কাটতে দেখা গেল। তিনি বলেন, ‘আজ (মঙ্গলবার) থেকে ধান কাটা শুরু করেছি। অথচ গত বছর এ সময় এখানে কোমরপানি ছিল। আমি কেন গত বছর এলাকার কোনো কৃষকই এক ছটাক ধান ঘরে তুলতে পারেননি।’ তিনি সোয়া লাখ টাকা খরচ করে ছয় একর জমিতে ধান আবাদ করেছেন। আশা করছেন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে তিনি ৪০০ মণ ধান পাবেন। বর্তমান বাজারদর ৮০০ টাকা মণ বিক্রি করলে সোয়া তিন লাখ টাকার মতো পাবেন।
সদরের জিরাতি কৃষক সাদেকুল ইসলাম এবার পৌনে দুই লাখ টাকা খরচ করে মিঠামইনের নোয়াগলা হাওরে আট একর জমি চাষ করেছেন। তিন-চার দিন পর থেকে তিনি ধান কাটা শুরু করবেন। সাদেকুল বলেন, গত বছর একই হাওরে ঋণ নিয়ে ১১ একর জমি করেছিলেন। এক রাতে ঢলের পানিতে পুরো হাওর তলিয়ে যায়। ধান নেওয়া তো দূরের কথা, শুধু ঘরটির কিছু অংশ নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি। গত বছরের ঋণের সুদে-আসলে এবার তাঁকে তিন লাখ টাকা দিতে হবে। আশা করছেন ধান তুলে তিনি তাঁর সব ঋণ শোধ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি আকাশে মেঘ দেখলেই আশঙ্কায় থাকেন, আবার কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসছে কি না।
কৃষক মানিক মিয়া ধান কাটার শ্রমিকের অপেক্ষায় আছেন। তিনি বলেন, একজন ধান কাটা শ্রমিককে দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরিসহ তিন বেলা খাওয়াতে হয়। এতে ধানের দামের সঙ্গে খরচের তুলনা করলে কৃষকের তেমন কিছু থাকে না। তাই তিনি সরকারের কাছে ধানের ন্যায্য মূল্যের দাবি জানান।
কৃষক রফিক মিয়া, তাহের উদ্দিনসহ অন্তত ১৫ জন কৃষক বলেন, গত বছর মিঠামইনে কোনো কৃষকই ঘরে ধান তুলতে পারেননি। এবার ফলন আশানুরূপ হয়েছে। কিন্তু জমিতে ধান পাকলেও প্রতিবছরই শ্রমিক সংকটে থাকেন। শ্রমিক মূল্য অত্যধিক হওয়ায় ও বাজারে ধানের ন্যায্য দাম না থাকার ফলে শেষ হাসিটুকু কৃষকের মুখে আর থাকে না। তাই সরকারকে কৃষকের এ বিষয়ে সুনজর দেওয়া উচিত।
কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলনের লক্ষ্যমাত্রাও ছাড়িয়ে গেছে। আশা করা হচ্ছে, এবার কৃষকেরা গত বছরের ক্ষতি কাটিতে উঠতে পারবেন।