নেপালে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত: তথ্যপ্রমাণ উদ্ধারের কাজ শুরু

কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের কাছে ইউএস–বাংলার বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ।  ফাইল ছবি
কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের কাছে ইউএস–বাংলার বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ। ফাইল ছবি
>
  • প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করতে তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে।
  • প্রাথমিক তদন্তে উড়োজাহাজের ত্রুটি পাওয়া যায়নি।
  • সংকট কাটিয়ে উঠছে ইউএস-বাংলা।

কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হওয়া ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজটির ব্ল্যাকবক্স এবং ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার থেকে তথ্য উদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে কানাডায়। সে দেশের ট্রান্সপোর্ট সেফটি বোর্ড এ কাজে সহায়তা করছে। এতে নেপালের তদন্তদলের সদস্যরা ছাড়াও বাংলাদেশের এভিয়েশন দুর্ঘটনা তদন্তদলের (এআইজি) প্রধানও রয়েছেন। এ দুটি যন্ত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করতে তিন মাসের মতো সময় লাগতে পারে বলে ঢাকায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের এভিয়েশন দুর্ঘটনা তদন্তদলের (এআইজি) প্রধান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনার অন্য সব তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কাজ শেষ করেছে কমিটি। এখন ব্ল্যাকবক্স এবং ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডারের তথ্য পাওয়ার কাজ শেষ হলেই সব মিলিয়ে দেখা হবে।

এ দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট ৯ এপ্রিল নেপালে প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, ইউএস-বাংলার যে উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু ছেড়ে যায়, সেটিতে কোনো কারিগরি ত্রুটি ছিল না। উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার ২৫ সেকেন্ড আগে পাইলট ও এটিসির (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল) মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। উভয় পক্ষের সামান্য যে কথোপকথন শোনা যায়, তা খুবই অস্পষ্ট।

কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পর নেপাল সরকার ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রধান নেপালের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সাবেক মহাপরিচালক যজ্ঞ প্রসাদ গৌতম। এর বাইরে বাংলাদেশের পক্ষে এই তদন্তদলের সঙ্গে যুক্ত আছেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ। তদন্তে বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজটির নির্মাণ সংস্থা বোম্বারডেয়ার, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বিমান চলাচল সংস্থা এফএএ এবং আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা-আইকাও যুক্ত রয়েছে। দুর্ঘটনার পর তদন্তদলের সদস্যরা ঘটনাস্থল ও বিধ্বস্ত বিমানটি পরীক্ষা করেন।

তাঁরা কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ বা কন্ট্রোল টাওয়ারের কথোপকথন ও সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণ করেন। এ ছাড়া ঘটনার সময় নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন।

বিপৎসংকুল কাঠমান্ডু
এমনিতে উড়োজাহাজ চালানোর ক্ষেত্রে নেপালকে বিশ্বের অন্যতম বিপৎসংকুল স্থান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। পাহাড়ি এলাকা ও দ্রুত পরিবর্তনশীল আবহাওয়াকে এর প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রথম উড়োজাহাজ অবতরণের পর থেকে এ পর্যন্ত ৭০ টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬৫০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার মালিন্দো এয়ারের একটি উড়োজাহাজ ত্রিভুবন বিমানবন্দরে দুর্ঘটনায় পড়ে। তবে এতে হতাহত হননি কেউ।

এই রুটে নিয়মিত চলাচল করেন এমন একজন পাইলট প্রথম আলোকে বলেছেন, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের ৯ মাইল দূরে রয়েছে এই পাহাড়। তাই এই রানওয়েতে কোনো উড়োজাহাজই সোজা অবতরণ করতে পারে না। ওই পাহাড় পেরোনোর পরপরই দ্রুত উড়োজাহাজ অবতরণ করাতে হয়। আবার উড্ডয়নের ক্ষেত্রেও ঝক্কি কম নয়।

কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে গত ১২ মার্চ ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার তিন দিন পর ওই বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছেত্রী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে উড়োজাহাজের নামা-ওঠার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে। যাঁরা আসবেন, তাঁদের আসতে হবে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েই।

রাজ কুমার ছেত্রী আরও বলছিলেন, ‘সমতলে ল্যান্ড করা আর কাঠমান্ডুতে ল্যান্ড করা অথবা নেপালের সমতলে ল্যান্ড করা এক নয়। আমাদের ল্যান্ডের চারপাশে ৮২ শতাংশই পাহাড়। আবার আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হয়। কখন কুয়াশা, কখন বৃষ্টি বা কখন মেঘ আসবে বলা যায় না। আগে থেকে আঁচ করা কঠিন। সমতলের সঙ্গে মেলানো যাবে না। তাই এখানে অনেক কিছুই প্রকৃতির হাতে।’

উড়োজাহাজে ত্রুটি ছিল না
বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজের কোনো ত্রুটি পায়নি তদন্ত কমিটি। ইউএস-বাংলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ইউএস-বাংলার প্রতিটি উড়োজাহাজ ওড়ার আগে তার সবকিছু ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। পাইলট নিজে সেটা বুঝে নেন। ১২ মার্চ বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজের পাইলট আবিদ সুলতানও সব দেখে নিয়েছিলেন। আবিদ সুলতান দক্ষ পাইলট। তিনি বহুবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণ করেছেন। তিনি বলেন, ওই দিন আবহাওয়া খারাপ ছিল না, আবার উড়োজাহাজে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। উড়োজাহাজটি নিয়ন্ত্রণ হারানোর কোনো কারণ ছিল না। তিনি মনে করেন, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভুল সংকেতের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

দুর্ঘটনার আগে উড়োজাহাজটি কে চালাচ্ছিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত যিনি কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তিনি উড়োজাহাজ চালান না। প্রথম যোগাযোগ করেছিলেন পৃথুলা রশীদ। এতে ধরা নেওয়া হচ্ছে, ওই সময় জাহাজটি চালাচ্ছিলেন আবিদ সুলতান। পরে যোগাযোগ করেন ক্যাপ্টেন নিজেই। আবিদ সুলতান ছিলেন পৃথুলার প্রশিক্ষক। এটি ছিল পৃথুলার প্রথম কাঠমান্ডু প্রশিক্ষণ ফ্লাইট। তদন্ত কমিটির আশঙ্কা, প্রথম দিকে টাওয়ারের সঙ্গে পৃথুলা যোগাযোগ করলেও পরিস্থিতি বুঝতে পেরে আবিদ সুলতান একই সঙ্গে দুটি কাজই করছিলেন। জরুরি প্রয়োজনে এটাও করা যেতে পারে বলে তাঁরা জানান।

সংকট কাটিয়ে উঠছে ইউএস-বাংলা
কাঠমান্ডু দুর্ঘটনার পর সংকটের মুখে পড়ে বেসরকারি খাতের অন্যতম বিমান চালনা সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। তবে সেই সংকট ইতিমধ্যে তারা কাটিয়ে উঠছে। তবে সংস্থাটি এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না, ঠিক কী কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।

২০১৪ সালে যাত্রা শুরু করা বেসরকারি উড়োজাহাজ সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস বর্তমানে দেশের সাতটি অভ্যন্তরীণ রুট এবং সাতটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়, চীনের বাণিজ্যিক শহর গুয়াংজুতে ফ্লাইট চালানোর প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছে। বর্তমানে তাদের হাতে চারটি বোয়িং ও তিনটি ড্যাশ ৮ কিউ ৪০০ বিমান রয়েছে। সংস্থাটি সপ্তাহে ৩০০ টির বেশি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এ বছরের মধ্যে তাদের বিমানবহরে আরও তিনটি বোয়িং ও তিনটি ড্যাশ ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ যুক্ত হবে। যাত্রা শুরু করার পর সাড়ে তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩৭ হাজার ফ্লাইট পরিচালনা করেছে, যা বাংলাদেশে উড়োজাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে একটি রেকর্ড।

ঢাকায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ফ্লাইট সেফটি অ্যান্ড রেগুলেশনস) উইং কমান্ডার চৌধুরী মো. জিয়াউল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার তদন্ত মানে এই নয় যে কাউকে জেল-ফাঁস দেওয়া। দুর্ঘটনার তদন্ত করা হয় ওই সময় আসলেই কী ঘটেছিল, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি হলে তা এড়িয়ে মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়।

প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ৭১ জন আরোহী নিয়ে ইউএস-বাংলার ড্যাশ ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় ২৭ বাংলাদেশি, ২২ নেপালি, এক চীনাসহ ৫০ জন মারা যান। আর ৯ বাংলাদেশি, ১১ নেপালি, মালদ্বীপের এক নাগরিকসহ ২১ জন আহত হন। দুর্ঘটনার পর আহত ব্যক্তিদের দেশে-বিদেশে চিকিৎসা করানো এবং নিহত ব্যক্তিদের মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার যাবতীয় ব্যবস্থা করে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস। হতাহত ব্যক্তিদের বিমার অর্থ আদায়েও তৎপর রয়েছে সংস্থাটি।