তেলের অভাবে একটি কেন্দ্র বন্ধ, আরেকটি বন্ধ হওয়ার পথে

সিরাজগঞ্জে বন্ধ হয়ে যাওয়া ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র
সিরাজগঞ্জে বন্ধ হয়ে যাওয়া ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র

জ্বালানির অভাবে সিরাজগঞ্জের ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের যে মজুত রয়েছে, তা দিয়ে আজ রোববার রাত পর্যন্ত কেন্দ্রটি সচল রাখা সম্ভব। এর কয়েক দিন আগে তেলের অভাবে সেখানকার আরেকটি ২২৫ মেগাওয়াটের ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। যমুনা নদীর পারে রাজশাহী অঞ্চলের এই বড় দুটি কেন্দ্রের বাকিটাও বন্ধ হলে চলতি গ্রীষ্মে উত্তরাঞ্চলে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।

সিরাজগঞ্জে সরকারি প্রতিষ্ঠান নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (এনডব্লিউপিজিসিএল) ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কেন্দ্রে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন সময়মতো জ্বালানি সরবরাহ করতে না পারায় এই সংকট তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে প্রায় সাড়ে ৯০০ মেগাওয়াট, তবে প্রকৃত চাহিদা এর থেকে বেশি। এই অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৫টি কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ৯১৩ মেগাওয়াট। আর সিরাজগঞ্জের এনডব্লিউপিজিসিএলের দুটি কেন্দ্রে উৎপাদিত হয় ৪৫০ মেগাওয়াট। এ কারণে দুটো কেন্দ্রই বন্ধ হলে রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

জ্বালানির মজুত সম্পর্কে জানতে চাইলে এনডব্লিউপিজিসিএলের সিরাজগঞ্জ ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক হারুন উর রশিদ গত শনিবার রাতে প্রথম আলোকে মুঠোফোনে বলেন, ‘আমাদের মজুতে যে তেল আছে, তা দিয়ে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত চলবে। তেলের অভাবে আগেই একটা ইউনিট আমরা বন্ধ করে দিয়েছি। এ সময়ের মধ্যে তেল না পেলে বাকিটাও বন্ধ রাখতে হবে।’

পিডিবি বলছে, সিরাজগঞ্জে এনডব্লিউপিজিসিএলের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চলছিল ডিজেল দিয়ে। ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কেন্দ্রে প্রতিদিন ২০ লাখ ৫০ হাজার লিটার ডিজেলের প্রয়োজন হয়। উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য খুলনার দৌলতপুর বিপিসির ডিপো থেকে রেলে করে তেল সরবরাহ করা হচ্ছিল। তবে গত সপ্তাহ থেকে রেল কর্তৃপক্ষ রেলের ইঞ্জিন সমস্যার কারণে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এ কারণে ইতিমধ্যে সিরাজগঞ্জে ২২৫ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী থেকে লরিতে করে তেল সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ তেল লরিতে করে এনে কেন্দ্র সচল রাখা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

গত ১৩ মার্চ সিরাজগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে এনডব্লিউপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিপিসিকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন। সাপ্তাহিক ছুটি, সরকারি ছুটির দিনসহ বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি তেল সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়ে চিঠি দেওয়ার পরও বিপিসি তাতে সাড়া দেয়নি।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বিপিসি বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি তেল সরবরাহ করবে এমন চুক্তি রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বিপিসি দেশের জরুরি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানকে ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে প্রস্তুত থাকার নিয়ম রয়েছে। ফলে বিপিসির তেল সরবরাহকারী তিন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা ছুটি বা বন্ধের দিন তেল সরবরাহ করবে না এমনটি বলার সুযোগ নেই। আর সপ্তাহে পাঁচ দিন শুধু লরিতে করে তেল এনে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সচল রাখাও সম্ভব নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে লরির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ তেল শুক্র ও শনিবার সরবরাহের অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু এ দুদিন তেল সরবরাহ করতে গেলে শ্রমিকদের বাড়তি মজুরি বা ওভারটাইম দিতে হয়। সেটি বিদ্যুৎ বিভাগ দেবে না। সে কারণে এ দুদিন তেল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওভারটাইম দিলে তেল দেবে বিপিসি।

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় গত কয়েক বছর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেছে বিপিসি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আগের তুলনায় তেলের দাম কিছুটা বাড়ায় কয়েকটি জ্বালানিতে বিপিসির এখন লোকসান হচ্ছে। জ্বালানি বিভাগে দেওয়া বিপিসির হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে লিটারপ্রতি ডিজেলে ৫ টাকা ২৪ পয়সা, ফার্নেস তেলে ৯ টাকা ৮০ পয়সা ও কেরোসিনে ১১ টাকা ৩৭ পয়সা লোকসান হচ্ছে। এতে দিনে এখন লোকসান হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এই অবস্থায় বিপিসি জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে দুই মাস আগে সরকারকে প্রস্তাব দেয়। তবে সরকার নির্বাচনের আগে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে আগ্রহী নয়। সর্বশেষ ১৫ এপ্রিল জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে জ্বালানি বিভাগে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বিপিসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার দাম বাড়াতে পারে এমন ধারণা থেকেই জ্বালানি তেল আমদানি কমিয়ে দিয়েছে বিপিসি। তবে অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আরও তেল কেনার অনুমোদন পাওয়া যাবে। তা ছাড়া ভারতের নুমালিগড় থেকেও সড়কপথে তেল আসবে। ফলে খুব বড় ধরনের সংকটে পড়তে হবে না বিপিসির। তখন হয়তো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রয়োজনীয় তেল পাবে।