গণিত উৎসবে প্রাণের স্ফুরণ

রঙিন বেলুনগুচ্ছ উড়িয়ে জাতীয় গণিত উত্সবের উদ্বোধন। গতকাল রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অতিথিদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীরা । ছবি: প্রথম আলো
রঙিন বেলুনগুচ্ছ উড়িয়ে জাতীয় গণিত উত্সবের উদ্বোধন। গতকাল রাজধানীর সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অতিথিদের সঙ্গে অংশগ্রহণকারীরা । ছবি: প্রথম আলো

একে পরীক্ষা, তার ওপর বিষয়টি অঙ্ক। ভয়ে বুক দুরুদুরু করারই কথা। কিন্তু হলুদ টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে যারা গতকাল শুক্রবার সকালে সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের শ্রেণীকক্ষের দিকে ছুটল পরীক্ষা দিতে—তাদের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ তো ছিলই না, বরং উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে মনে হচ্ছিল, অঙ্কের চেয়ে মজার কোনো বিষয় আর হতেই পারে না।
গত এক যুগের চেষ্টার এই ফল। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অঙ্কভীতি কাটিয়ে এখন উৎসবে মেতে উঠেছে অঙ্ক নিয়ে। গতকাল ছিল সেই উৎসবেরই জাতীয় পর্যায়ের চূড়ান্ত আয়োজন: ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় গণিত উৎসব ২০১৪ ও দ্বাদশ বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড। এবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড হবে দক্ষিণ আফ্রিকায় আগামী ৩ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত। তাতে অংশগ্রহণের জন্যই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় দেশজুড়ে গণিত উৎসবের আয়োজন করে।
এবার আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল জানুয়ারি মাসে। প্রতিযোগিতা হয়েছে ২২টি অঞ্চলে। গত বছর হয়েছিল ১৭টি অঞ্চলে। প্রাথমিক, জুনিয়র, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি—এই চারটি বিভাগে ২৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এতে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে বিজয়ী এক হাজার ৫৫ জনকে নিয়ে গতকাল শুক্রবার থেকে ঢাকায় শুরু হলো দুই দিনের জাতীয় উৎসব। দেশে গণিতের এই উৎসব শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। এবার হলো তার যুগপূর্তি। এই এক যুগের সাফল্য—দেশের তরুণদের নয়টি অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে একটি রৌপ্য, আটটি ব্রোঞ্জসহ নয়টি পদক জয়।
উৎসবের জমকালো সাজে সাজানো হয়েছিল সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের বিরাট মাঠটি। দক্ষিণ প্রান্তে শামিয়ানা টানিয়ে উৎসব মঞ্চ। পশ্চিম পাশে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর বুথ। উত্তর আর পূর্বে বিভিন্ন প্রকাশনী ও প্রতিষ্ঠানের স্টল। এর মধ্যে ছিল প্রথমা, কিশোর আলো, তাম্রলিপি, সময়, মুক্ত আসর, বন্ধুসভা, এভারেস্ট একাডেমির অ্যাডভেঞ্চারার্স ক্লাব, মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক বইয়ের স্টল। আরও ছিল আঞ্চলিক উৎসবগুলোর ছবি, অলিম্পিয়াডে পদকজয়ীদের ছবিসংবলিত বিশালাকার বোর্ড।
অংশগ্রহণকারীদের নাম নিবন্ধন শুরু হয়েছিল সকাল আটটা থেকে। সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের অধ্যক্ষ ব্রাদার রবি পিউরিফিকেশন জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে উৎসবের উদ্বোধন করেন। এমন একটি উৎসবের কেন্দ্র হিসেবে তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়ার জন্য তিনি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান। এই আয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিতের প্রতি আরও আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করেন দেশের গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি নবীন শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিয়ে বলেন, প্রতিবছরই অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়ছে। ভবিষ্যতে হয়তো এই মাঠে আর জায়গাই হবে না। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা গ্রহণ করছে। তিনি বলেন, যেভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম শিক্ষা-বিজ্ঞানের চর্চায় এগিয়ে এসেছে, তাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিজ্ঞানে আমাদের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের পতাকা উত্তোলন করে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এস তাবরেজ বলেন, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এই আয়োজনের সঙ্গে জড়িত হয়ে আনন্দিত। গণিত অলিম্পিয়াড থেকে দেশের প্রতিযোগীরা ব্রোঞ্জ ও রৌপ্যপদক জয় করেছে। ভবিষ্যতে স্বর্ণপদকও জয় করবে বলে তিনি শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করেন।
দেশের সব ধর্মের মানুষ যেন মিলেমিশে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে, সে জন্য নবীন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানালেন কমিটির সহসভাপতি অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, ‘এই দেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ—সবাইকে মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতে হবে। হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে। তাদের অনেকেই হয়তো এই উৎসবে আসতে পারছে না। সবাই যেন আসতে পারে, তোমাদের সেই দায়িত্ব নিতে হবে। তা না হলে শুধু অঙ্ক নিয়ে মেতে থাকা আর পদক জয় করা অর্থবহ হবে না।’
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে বিগত এক যুগে গণিত অলিম্পিয়াডের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরে বলেন, ছোট করে শুরু হলেও আজ গণিত উৎসব দেশের একটি বিশাল উৎসবে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতে আরও বড় সাফল্য আনবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন খোদাদাদ খান, লুৎফুজ্জামান, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, এফ আর খান, আনোয়ার হোসেন, রাশেদ তালুকদার, মোহিত কামাল, মুসা ইব্রাহীম, মুনির হাসান প্রমুখ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরেই শুরু হয় পরীক্ষা পর্ব। অংশ নিতে শিক্ষার্থীরা ছুটল শ্রেণীকক্ষের দিকে, আর তাদের সঙ্গে আসা অভিভাবকেরা কেউ গেলেন স্টলগুলোর সামনে, কেউ বিশ্রাম নিলেন মঞ্চের সামনে পাতা চেয়ারে বসে।
পরীক্ষার পর ব্যবস্থা ছিল দুপুরের খাবারের। এরপর সন্ধ্যা অবধি আনন্দের হরেক আয়োজন। জল রকেট ওড়ানো, সুডোকু প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আনন্দ আরও বেড়েছিল প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে কাছে পেয়ে। সকালে পরীক্ষা থাকায় শিক্ষার্থীরা তাঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহ আর ছবি তোলার সুযোগ তেমন পায়নি। তিনি মাঠে আসামাত্রই সবাই ঘিরে ফেলে তাঁকে। একপর্যায়ে মঞ্চ থেকে ‘জাফর স্যার জাফর স্যার, মঞ্চে আসুন, মঞ্চে আসুন’ স্লোগান দিয়ে তাঁকে মঞ্চে আনা হয়। মজার মজার কিছু গল্প শোনালেন তিনি শিক্ষার্থীদের। এ পর্বে মঞ্চে ছিলেন লুৎফুজ্জামান, দেশের সর্বকনিষ্ঠ ফিদে মাস্টার ফাহাদ রহমান ও মুসা ইব্রাহীম।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর্ব শুরু হয়েছিল সমবেত কণ্ঠে গণিত উৎসবের গান ‘মন মেলে শোন শুনতে পাবি বিজয়ের আহ্বান/ গণিতের ধ্বনিতে বাজে ঐ মুক্তির জয়গান’। পরে বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থীরা আবৃত্তি, অভিনয়, নৃত্য ও গানে গানে মুখর করে তোলে বসন্তের গোধূলি বেলা।
আজকের আয়োজন: আজ সমাপনী দিনের অনুষ্ঠান শুরু হবে সকাল সাড়ে আটটায়। থাকবে গণিতের পট, ভাষা ও দেশের গান, রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতা, সমাপনী অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণী। অনুষ্ঠানটি সরাসরি www.prothom-alo.com ও www.matholympid.org.bd তে দেখা যাবে।