মিরপুর-১-এর কলোনির শিশুদের দিন কাটছে ভয়ে ভয়ে

>
মিরপুর পাইকপাড়া সি টাইপ সরকারি কলোনির মাঠে প্রতিদিন বিকেলে শিশুদের কলরবে মুখর থাকত। এখন থাকে প্রায় নিরিবিলি। গতকাল বিকেলে কয়েকটি শিশুকে ক্রিকেট খেলতে দেখা যায়।  ছবি: প্রথম আলো
মিরপুর পাইকপাড়া সি টাইপ সরকারি কলোনির মাঠে প্রতিদিন বিকেলে শিশুদের কলরবে মুখর থাকত। এখন থাকে প্রায় নিরিবিলি। গতকাল বিকেলে কয়েকটি শিশুকে ক্রিকেট খেলতে দেখা যায়। ছবি: প্রথম আলো

মিরপুর-১-এর সরকারি বাঙলা কলেজের পাশে সি টাইপ সরকারি কলোনির শিশুদের দিন কাটছে ভয়ে ভয়ে। অনেকেই রাতে ঘুমোতে পারছে না। গত ৩০ এপ্রিলের মা ও দুই মেয়ের গলা কেটে মৃত্যুর ঘটনার কথা ভুলতে পারছেন না বড়রাও। ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও কলোনিজুড়ে ভীতিজাগানিয়া পরিবেশ বিরাজ করছে।

গতকাল বুধবার কোয়ার্টারে গিয়ে একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই নৃশংস ঘটনা শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নিহত দুই বোন কলোনিতে তাদের সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করত। ফলে শিশুরা তাদের মা-বাবার কাছে মাঝেমধ্যেই নানা ধরনের প্রশ্ন করছে। এ রকম একজন অভিভাবক নুসরাত জাহান, তিনি বলেন, ‘আমার ছয় বছর বয়সী ছেলে বাথরুমে যেতে ভয় পাচ্ছে। রাতে ঘুমোতে পারছে না। ওই দুই বোনের এমন হলো কেন, জানতে চাচ্ছে। এ প্রশ্নের আমি কী উত্তর দেব? আমি নিজেও স্বাভাবিক হতে পারিনি এখনো।’

সরেজমিনে দেখা যায়, এই সরকারি কলোনির খেলার মাঠে অল্প কয়েকজন কিশোর ক্রিকেট খেলছে। শিশুদের উপস্থিতি খুবই কম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলোনির এক বাসিন্দা বলেন, ‘বিকেল হলেই শিশুদের কলতানে এই মাঠ ভরে যেত। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে বাচ্চারা বাসা থেকে নিচে নামতেই ভয় পাচ্ছে। সন্ধ্যার পরে তো কেউই নিচে নামে না। জানি না এই অবস্থা থেকে কবে মুক্তি মিলবে।’

কলোনিজুড়ে রয়েছে পাঁচতলা উচ্চতার ১০টি ভবন। এর ১৩৪ নম্বর ভবনের চারতলায় দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতেন হাসিবুল ইসলাম-জেসমিন আক্তার দম্পতি। ওই ভবনের তিনতলায় থাকেন ফারজানা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘দুই মেয়ে হিমি আর হানিকে নিয়ে একটা সুখী পরিবার হিসেবেই আমি ওদের দেখেছি। আমাদের বাসায় জেসমিন ভাবি প্রায়ই আসতেন। হিমি ছিল আমার মেয়ে তাহিমার বন্ধু। ও কিছুতেই ঘটনাটি ভুলতে পারছে না।’

চারতলার ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা যায়, যে কক্ষ থেকে মা ও দুই মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তা সিলগালা করে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাকি দুটি কক্ষের একটিতে থাকছেন হাসিবুল ইসলামের ভাগনে রওশন জামিল ও তাঁর স্ত্রী রুমানা বেগম। হাসিবুল বলেন, ‘আমরা দুজনেই সরকারি চাকরি করতাম। সংসারে কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু জেসমিন তার অসুস্থতা আর দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে সব সময় শঙ্কিত ছিল। মাইগ্রেনের চিকিৎসার জন্য তাকে দুবার ভারতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু এ রকম ঘটনা কল্পনা করতে পারিনি।’

এ ধরনের নৃশংস ঘটনার কথা শুনলে কিংবা দেখলে শিশুরা নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে বলে জানিয়েছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, এমন ঘটনায় শিশুমনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে। স্বল্পমেয়াদি প্রভাবগুলোর মধ্যে অহেতুক ভীতি, উদ্বিগ্নতা, ঘুমোতে না পারার মতো সমস্যা হতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে এই দুঃসহ স্মৃতি বারবার মনে পড়বে। এ ক্ষেত্রে ভীতি কাটানোর জন্য শিশুরা স্বাভাবিক সময়ে ওই কলোনির যেসব জায়গায় বিচরণ করত, সেসব জায়গায় তাদের নিয়ে যেতে হবে। প্রথম প্রথম ভয় পেলেও ধীরে ধীরে তাদের ভীতি কেটে যাবে।

মা ও দুই মেয়ের মৃত্যুর তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের দারুস সালাম অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জেসমিন আক্তার দুই কন্যাকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেছেন ধরেই আপাতত তদন্ত চলছে। তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে যে চিরকুটটি পাওয়া গিয়েছিল, তা ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হয়েছে হাতের লেখা নিশ্চিত হওয়ার জন্য। ময়নাতদন্তের রিপোর্টও আসেনি। এসব রিপোর্ট এলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।