খুলনা সিটিতে গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপির নেতা-কর্মীরা

টুটপাড়ায় নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু (বাঁয়ে)। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে প্রচারে ব্যস্ত আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক। গতকাল খুলনায়।  ছবি: প্রথম আলো
টুটপাড়ায় নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু (বাঁয়ে)। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে প্রচারে ব্যস্ত আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক। গতকাল খুলনায়। ছবি: প্রথম আলো
>
  • বিএনপির নেতা-কর্মী রাতে নিজের বাসায় থাকছেন না।
  • মাঠ থেকে উঠিয়ে দিতে অভিযান: বিএনপি
  • সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার: পুলিশ

গ্রেপ্তারের ভয়ে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী রাতে নিজের বাসায় থাকছেন না। দিনে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিলেও রাত বাড়লে তাঁরা নিজেদের সুবিধামতো জায়গায় চলে যাচ্ছেন। কয়েক দিন ধরে পুলিশের ধরপাকড় চলতে থাকায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে ভুগছেন তাঁরা।

দলটি মনে করছে, পুলিশ বিএনপিকে মাঠ থেকে উঠিয়ে দিতে অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশ অবশ্য বলছে, কোনো নির্দিষ্ট দলের নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, গত কয়েক দিনে নগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে তিন শতাধিক নেতা-কর্মীর বাড়িতে হানা দিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ১০০ জনকে। যাঁদের নামে কোনো মামলা নেই, আগের নাশকতার ও ছোটখাটো মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। কাউকে কাউকে মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিএনপি নেতা-কর্মীদের এমন অভিযোগের মধ্যেই গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পুলিশ ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ক্লাবের মোড়ে অবস্থিত বিএনপির নির্বাচনী কার্যালয়ে অভিযান চালায়। পুলিশ ওই কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এ সময় শাকিল নামের এক বিএনপি কর্মীকে আটক করে পুলিশ। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

গতকাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু অভিযোগ করলেন, নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি ও সাঁড়াশি অভিযানের নামে এখনো গণগ্রেপ্তার করছে পুলিশ। গত বুধবার রাতে নেতা-কর্মীদের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বিএনপির নির্বাচনী এজেন্ট, ওয়ার্ড নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক, সদস্যসচিব, এমনকি সেন্টার কমিটির নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশ গিয়েছে।

গত এক সপ্তাহে পুলিশ বিএনপির ৯১ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে-এমন অভিযোগ তুলে নজরুল ইসলাম বলেন, বিএনপির এক কর্মীর বাবার ইজিবাইকের গ্যারেজে তালা মেরে দিয়েছে পুলিশ। এক কর্মীর মোটর সাইকেল পুলিশ গাড়িতে তুলে নিয়ে গেছে। এভাবে নানাবিধ নিপীড়ন বিএনপির ওপর চালানো হচ্ছে।

বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী বলেন, ‘আমি নির্বাচন করছি, আর আমার কর্মীরা নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারবে না। আমরা বক্তব্য দেব আর পুলিশ বলবে, তারা সন্ত্রাসী অভিযান চালাচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’

বিএনপির নির্বাচনী প্রচারে নিয়মিত অংশ নেওয়া ১২ জন নেতা-কর্মীর সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার কথা বলেন প্রথম আলোর এ দুই প্রতিবেদক। এ সময় তাঁরা জানান, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক তত বাড়ছে। বিভিন্ন মাধ্যমে পুলিশের দেওয়া বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তারা অভিযান বন্ধ করবে না। তাই রাতে তাঁরা নিজের বাড়িতে থাকছেন না। অনেকে সন্ধ্যার পর শহরের বাইরে অবস্থান করছেন। এখন তাঁদের একটাই চিন্তা যেভাবে হোক ভোটটা দিতে পারা। দিনের বেলা প্রচারে বের হলেও সতর্ক থাকতে হচ্ছে।

যুবদলের এক নেতা বলেন, ‘এক বালিশে প্রতিদিন মাথা রাখা নিরাপদ বোধ করছি না। প্রতিদিনই বালিশ পাল্টাতে হচ্ছে।’

৩ মে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া রূপসা থানা বিএনপির এক নেতার ভাই বলেন, তাঁর ভাই নগরে গিয়ে নিয়মিত বিএনপির প্রচারে অংশ নিতেন। তাঁকে আগের একটি চুরির মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।

জানতে চাইলে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) সোনালী সেন বলেন, বিএনপি বা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বা সমর্থক হিসেবে নয়, নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এই অপরাধীদের আগে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি-জানতে চাইলে গত বুধবার কেএমপি কমিশনার মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আগেও তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলেছে। তখন পাওয়া যায়নি। যখন পাচ্ছি তখন ধরছি।’

বিএনপির সংবাদ সম্মেলন
গতকাল দুপুরে নগরের কেডি ঘোষ রোডের দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি। সেখানে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি আবারও তোলে দলটি।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছিল। এবার খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে দেখতে চাই, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেমন হবে।’

কেসিসি নির্বাচনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক গয়েশ্বর আরও বলেন, গাজীপুরে আওয়ামী লীগের লোক নির্বাচন স্থগিতে রিট করল। এটা তাদের আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিল। হঠাৎ করে এটা হয়নি। খুলনা সিটি নির্বাচন স্থগিতের ব্যাপারেও তাদের একটি রিট করা আছে, যেটা কজলিস্টে প্রকাশ করা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উদ্দেশে বিএনপির প্রার্থী নজরুল ইসলাম বলেন, জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে, নিরাপদ করতে অবিলম্বে খুলনায় সেনাবাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিন। একজন যুগ্ম সচিবকে নির্বাচনে সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়াকে নির্বাচনী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, আবদুল আওয়াল মিন্টু, বরকত উল্লা বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক, মশিউর রহমান, হাবিবুর রহমান ও মেহেদী হাসান, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির, সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীন, শামা ওবায়েদ প্রমুখ।

১৪ দলের মতবিনিময়
বিএনপির সংবাদ সম্মেলনের পর খুলনা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ১৪ দল। বিএনপির অভিযোগের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ২০১৩ সালে শেখ হাসিনার অধীনেই চারটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়ও বিএনপি অভিযোগ করেছিল, নির্বাচন কমিশন সরকারের হয়ে কাজ করছে। যখন তাঁরা চারটি সিটিতেই জয় পেয়ে গেলেন, তখন আর কোনো কথাই বললেন না।

কামাল হোসেন বলেন, বিএনপির সমস্যা হচ্ছে তারা নিজেরা। তারা আন্তর্জাতিকভাবে যারা আসে, তাদের কাছে অভিযোগ দেয়, আবার দেশের মধ্যেও অভিযোগ দেয়। বিএনপির কর্মকাণ্ডে জনগণ এখন বুঝে গেছে এরা নালিশ-পার্টি।